লন্ডন: বাংলাদেশের এলিট ফোর্স নামে খ্যাত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে জিজ্ঞাসাবাদের নামে গ্রেপ্তারকৃতদের ওপর নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠছিল দীর্ঘদিন ধরে, সেই নির্যাতনের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে এবার।
র্যাব হেফাজতে কতিপয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ নাগরিকের ওপর নির্যাতনের সঙ্গে ব্রিটেনেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে ব্রিটেনের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক গার্ডিয়ানের এক দীর্ঘ অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছে।
রিপোর্টটি প্রকাশ পাওয়ার পরই এ নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। ব্রিটেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
আয়ান কোবেইন ও ফারিহা করিমের প্রতিবেদন ‘ইউকে লিঙ্ক টু নটোরিয়াস বাংলাদেশ টর্চার সেন্টার’ শীর্ষক গার্ডিয়ানের ঐ রিপোর্ট সোমবার প্রকাশিত হয়।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কয়েকজন ব্রিটিশ নাগরিককে র্যাব এর টিএফআই সেলে নির্যাতনের বিষয়টি তৎকালীন লেবার দলীয় ব্রিটিশ সরকারও অবহিত ছিল।
বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হওয়া এসব ব্রিটিশ নাগরিক ব্রিটেনের জন্যেও হুমকি এমন আশঙ্কা থেকে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার র্যাবের সহযোগিতায় ঐ ব্যক্তিদের কাছ থেকে হুমকি সম্পর্কিত তথ্যগুলো জানতে চেয়েছিল। আর এ ল্েযই ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৫ ঐ সময় র্যাবের সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃতদের সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য আদান প্রদান করতো।
বাংলাদেশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া এক ডজনেরও বেশি বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ নাগরিকের মধ্যে কয়েকজনকে নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে গার্ডিয়ানের রিপোর্টে বলা হয়, মৃতুকূপ হিসেবে পরিচিত র্যাব এর ঐ নির্যাতন সেলে ব্রিটিশ নাগরিকদের নির্যাতনের বিষয়ে ব্রিটেন ঐ সময় পুরোপুরি অবগত ছিল।
চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে বলা হয়, র্যাব এর মানবাধিকার লংঘনের এ সকল ঘটনায় বাংলাদেশ ও বৃটিশ সরকারের ধারাবাহিক যোগাযোগ ছিল। যে সকল বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত বৃটিশ নাগরিককে বৃটেনের জন্য হুমকি মনে করা হয়েছে ব্রিটেনের সম্মতিতেই তাদের র্যাব-এর গোপন সেলে রেখে নানাভাবে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে।
র্যাবের নির্যাতন নিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, টিএফআই সেলে আটককৃতদের বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, না খাইয়ে রেখে দুর্বল করা এবং পায়ের আঙুল ভেঙে দেওয়ার মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হতো। রিপোর্টে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ঐ ব্রিটিশ নাগরিকদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ তদন্তকালীন ব্রিটেন ও বাংলাদেশের গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) এর মধ্যে ধারাবাহিক তথ্যের আদান প্রদান হতো বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্রিটিশ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে চাঞ্চল্যসৃষ্টিকারী ঐ রিপোর্টে নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ঐ সময় ডিজিএফআই এর সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠক করার জন্যে খোদ ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাকি স্মিথ ঢাকায় যান।
তবে জ্যাকি স্মিথ বাংলাদেশ সফর করার আগে বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত নির্যাতনের ব্যাপারে ব্রিটিশ হোম অফিসের একটি প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করার কথাও ঐ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
রিপোর্টে বাংলাদেশের ভোলার একটি মাদ্রসা থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া উত্তর ইংল্যান্ডের ম্যানচেষ্টারের বাসিন্দা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ফয়সাল মোস্তফার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ব্রিটেনের হোম সেক্রেটারি জ্যাকি স্মিথের ঢাকা সফরের পর ফয়সালকে ৬ দিন টিএফআই সেলে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ সময় তাকে মারধর এবং ইলেকট্রিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হয়।
র্যাব এর তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল মতিউর রহমানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, র্যাব হেফাজতে গ্রেপ্তার হওয়া সন্দেহভাজন ব্রিটিশ বাঙালি ফয়সাল মোস্তফা সম্পর্কে বিভিন্ন সময় তথ্য চেয়েছে ব্রিটিশ সরকার। ফয়সাল মোস্তফা একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক এর সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ ছিল ব্রিটেনের। আর তাই ফয়সালকে ব্রিটেনের জন্যে হুমকি মনে করতো ব্রিটিশ সরকার।
রিপোর্ট মোতাবেক ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাব এর মধ্যে পারষ্পরিক তথ্য বিনিময়ের কথাও গার্ডিয়ানের কাছে স্বীকার করেন কর্নেল মতিউর।
গোলাম মোস্তফার উদ্ধৃতি দিয়েও র্যাব এর অমানুষিক নির্যাতনের বর্ণণা দেওয়া হয় ঐ রিপোর্টে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি গোয়েন্দা কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে গার্ডিয়ানের রিপোর্টে বলা হয়, র্যাবের প থেকে গোলাম মোস্তফাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ সম্বলিত যে ফাইল দেওয়া হয় ঐ গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে, তাতে গোলাম মোস্তফার স্বীকারোক্তির প্রতি ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৫ এর চাহিদার ইঙ্গিত ছিল। এমআই-৫ এর ফাইল হিসেবে ঐ ফাইল চিহ্নিত ছিল। মোস্তফাকে গ্রেফতার করার পর ব্রিটিশ হাইকমিশন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ কর্মকর্তা জানান।
ব্রিটিশ হাইকমিশন ঐ সময় জিজ্ঞাসাবাদে মোস্তফার দেওয়া তথ্য সম্পর্কে র্যাব এর কাছে জানতে চেয়েছিল বলে ঐ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানায় গার্ডিয়ান।
গার্ডিয়ানের চাঞ্চল্যকর ঐ রিপোর্টে র্যাব এর হাতে নির্যাতিত তৃতীয় ব্রিটিশ বাঙালি জামিল রহমান এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ২০০৫ সালে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের নামে জামিলের ওপর যে নির্যাতন হয়েছিল তার সঙ্গেও এমআই-৫ সরাসরি জড়িত ছিল।
জামিল গার্ডিয়ানকে জানান তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনে ২জন ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তাও অংশ নিয়েছেন।
পরবর্তীকালে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে এমআই-৫ ও এমআই-৬ এর তথ্য যোগাযোগ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করা হয় উল্লেখ করে গার্ডিয়ানের রিপোর্টে বলা হয়।
বাংলাদেশের র্যাবের নির্যাতনের সাথে তৎকালীন লেবার দলীয় ব্রিটিশ সরকারের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাকি স্মিথ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে, র্যাব নির্যাতনের সাথে ব্রিটেনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠায় ব্রিটেনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
মানবাধিকার নেতা ব্রিটেনের অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস কমিটির ভাইসচেয়ার লর্ড অ্যাভেবুরির অফিস থেকে বাংলানিউজকে জানানো হয়, আগামী ২৪ জানুয়ারি হাউস অব লর্ডসে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিষয়ক সেমিনারে বিষয়টি উত্থাপিত হবে।
লর্ড অ্যাভেবুরির মূখপাত্র সুজিত সেন বাংলানিউজকে বলেন, গার্ডিয়ানের রিপোর্ট সভ্য দুনিয়ায় ব্রিটেনকে হেয় করবে সন্দেহ নেই। এই বিষয়টি নিয়ে ওই সেমিনারে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অ্যাভেবুরির।
বাংলানিউজের প থেকে র্যাবের হাতে নির্যাতিত ম্যানচেস্টারের স্টোকপোর্টে বসবাসরত ফয়সাল মোস্তফার প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগ করলে তাকে পাওয়া যায়নি। ফয়সালের বাবা গোলাম মোস্তফা গার্ডিয়ানের রিপোর্ট সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
ফয়সালের গ্রেফতার সম্পর্কে গার্ডিয়ান আগে আরও রিপোর্ট করেছে উল্লেখ করে গোলাম মোস্তফা বলেন, তবে এবারের রিপোর্টে র্যাব এর নির্যাতনের কথা বিশদভাবে উঠে এসেছে, যা সত্যিই ভয়ঙ্কর।
ফয়সলের বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন বলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি নন বলে বাংলানিউজকে জানান।
উল্লেখ্য, ফয়সাল জামিনে মুক্ত হয়ে ব্রিটেনে ফিরে আসার পর বর্তমানে ম্যানচেস্টারে বসবাস করছেন। তাঁর জামিন মেয়াদ শেষ হলেও তিনি আর দেশে ফিরে যাননি।
বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতা মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদের ভাইয়ের ছেলে ম্যানচেস্টারের গ্রিন ক্রিসেন্ট চ্যারিটি সংস্থার কর্ণধার ফয়সাল বাংলাদেশের ভোলায় একটি মাদ্রাসা থেকে বিপুল অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়ে গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীতে র্যাব হেফাজতে তাকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১০ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১১
Link to Article
Syed Anas Pasha
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Popular Posts
-
বৌদ্ধদের উপর হামলার প্রতিবাদে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ বক্তব্য রাখছেন একজন ভিক্ষু বক্তব্য রাখছেন বৌদ্ধিষ্...
-
Link to Article মঈনুদ্দিনের বিচার দাবিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলীপী
-
বিএনপিকে অর্থ দেওয়ার কথা স্বীকার সাবেক আইএসআই প্রধানের সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন : ১৯...
-
Syed Anas pasha, London Correspondent banglanews24.com LONDON: Senior vice-chairman of BNP Tarrique Rahaman asserted that the next ...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী- ছবি: মনিরুজ্জামান সামি ...
-
Amnesty for probe into Sylhet deaths London Correspondent banglanews24.com DHAKA: Amnesty International demanded investigation in...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন: যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতের মদদপুষ্ট হেফাজতি ভোটের কথ...
-
UK court awards 9 men, including 6 Bangladeshis Syed Anas Pasha, London Correspondent banglanews24.com LONDON: A British Court award...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন: মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশের...
0 comments:
Post a Comment