লন্ডন: লন্ডনে বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনার। প্রতিবছর ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে যেখানে মিলন ঘটে ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা হাজারো বাঙালির। নিজ শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার এই অদম্য ইচ্ছের কাছে ফেব্রুয়ারির এই হীম শীতল রাতও বার বার পরাস্ত হচ্ছে প্রতি বছর বাঙালির কাছে।
ব্রিটেনে বাঙালির সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। নিজ সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিটেনে বাঙালির আজকের এই শক্ত ভিত্তির অবস্থান, সদ্য ব্রিটেনে পাড়ি জমানো অনেককে আবেগে আপ্লুত করলেও এই পর্যায়ে পৌঁছতে বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস হয়তো অনেকেই জানেন না।
১৯৯৯ সালে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে প্রতিষ্ঠিত আজকের শহীদ মিনারটি বাঙালির ভাষা-শহীদদের স্মরণে বহির্বিশ্বের প্রথম শহীদমিনার। এই শহীদ মিনারটি প্রতিষ্ঠার অনেক আগ থেকেই ব্রিটেন বিশেষ করে লন্ডনে বসবাসরত বাঙালিরা অস্থায়ী শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন।
ব্রিটেনে বাঙালি কমিউনিটির সর্ববৃহৎ ও প্রচীনতম সংগঠন বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনের সাড়ে বায়ান্নো হ্যানবারি স্ট্রিটের একটি হলে অস্থায়ী শহীদমিনার তৈরি করে এই শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যবস্থা করা হতো। দীর্ঘ কয়েক বছর এভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে খোলা আকাশের নিচে একটি শহীদমিনার প্রতিষ্ঠার জন্যে স্থানীয় কাউন্সিলের সঙ্গে দেনদরবার শুরু হয়। এমনি এক পর্যায়ে ৮০ এর দশকে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে শহীদ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আলতাব আলীর নামে নামকরণ করে পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল রোডের পার্কে ১৯৯৮ সালের একুশে ফেব্র“য়ারি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে প্রথম অস্থায়ীভাবে একটি শহীদমিনার স্থাপন করে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
প্রথম খোলা আকাশের নিচে শহীদমিনার তৈরি করে ভাষা-শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এই কর্মসূচি স্থায়ী শহীদমিনার সৃষ্টির আন্দোলনকে আরো বেগবান করে।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সঙ্গে এ বিষয়ে দেন-দরবারের এক পর্যায়ে একটি স্থায়ী শহীদমিনার নির্মাণে কাউন্সিল-কমিউনিটি ঐক্যমতে পৌঁছতে সম হয়। কাউন্সিলের প থেকে কমিউনিটিকে প্রস্তাব দেওয়া হয় জায়গা বরাদ্ধ দেবে কাউন্সিল, কিন্তু শহীদমিনার তৈরির খরচ বহন করতে হবে কমিউনিটিকে। এই প্রস্তাবে কমিউনিটির সম্মতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন শুরু করে ফান্ড সংগ্রহ তৎপরতা।
এ তৎপরতায় এগিয়ে আসে বাংলাদেশ হাইকমিশন, সোনালী ব্যাংক, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পাটি, কমিউনিস্ট পার্টি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জাসদ ও উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীসহ ৫৪টির মতো সংগঠন। আর এই ৫৪ সংগঠনের যৌথ অংশগ্রহণে গঠন করা হয় কেন্দ্রীয় শহীদমিনার কমিটি। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের প থেকে আলতাব আলী পার্কে স্থায়ী শহীদমিনার নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হলে কেন্দ্রীয় শহীদমিনার কমিটি এর ব্যয় নির্বাহে সম্মতি জানায়।
ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনসহ ৫৪টি সংগঠনের প থেকে শহীদ মিনার নির্মাণের ব্যয় হিসেবে কাউন্সিলের কাছে তুলে দেওয়া হয় প্রায় ২২ হাজার পাউন্ড।
এভাবেই আলতাব আলী পার্কে স্থায়ীভাবে নির্মিত হয় বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক শহীদমিনার।
এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালে স্থায়ী শহীদমিনারে ভাষা-শহীদদের প্রতি প্রথমবারের মত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন ব্রিটেনের বাঙালিরা। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল ও কেন্দ্রীয় শহীদমিনার কমিটির যৌথ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, প্রতি বছর ২০ ফেব্র“য়ারি মধ্যরাতে শহীদমিনার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করবে যৌথভাবে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল ও কেন্দ্রীয় শহীদমিনার কমিটি।
নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার দায়িত্বসহ ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পুরো অনুষ্ঠানটির খরচ বহন করবে কাউন্সিল। এভাবেই ১৯৯৯ সাল থেকে চলে আসছে বাঙালির ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রতি বছরের কর্মসূচি। প্রতি বছর ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে শহীদ মিনারে ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ও টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মেয়রের পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দিনের কর্মসূচি শুরু হয়।
প্রতি বছরই জ্যামিতিক হারে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতের সমাগম বাড়ছে আলতাব আলী পার্কে। ২০ ফেব্রুয়ারির হীম শীতল এই মধ্যরাতে বিশাল আলতাব আলী পার্কটি হয়ে যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদমিনার প্রাঙ্গণের মত একখন্ড বাংলাদেশ।
২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাঙালির এই সমাগম অনেকটা বহু-সংস্কৃতির মিলনমেলায় রূপ নিয়েছে। বাঙালির বাইরেও বিভিন্ন ভাষাভাষীরা ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে এখন বাঙালির শহীদমিনারে আসেন। তাদের কণ্ঠেও ধ্বনিত হয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সেই অমর গান ‘ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো/ একুশে ফেব্রুয়ারি,/ আমি কি ভুলিতে পারি------’ । ভাষাদিবসের এই শ্রদ্ধা নিবেদনের অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর যেভাবে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে এটি বৈশাখী মেলার মত লাখ লাখ লোকের জনসমাগমে পরিণত হবে, এমনটাই আশা করছেন ব্রিটেনপ্রবাসী বাঙালিরা।
এদিকে, প্রতি বছরের মত এবারও ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারে নামবে জনতার ঢল, এমনই আশা করছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কমিটি।
কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, শহীদ মিনার প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে আমাদের সাহস যোগায়। শুধু বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনই নয়, ব্রিটেনে বর্ণবাদ, জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থাবিরোধী সব আন্দোলনেও আমরা প্রেরণা পাই আলতাব আলী পার্কের শহীদমিনার থেকে। এই শহীদ মিনার এতোদিন বাঙালির প্রেরণার উৎস হলেও ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এটি এখন বিশ্বের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সব মানুষের জন্যই প্রেরণার উৎস।
শহীদমিনার কমিটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল ও স্থানীয় কমিউনিটির যৌথ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত এই শহীদমিনারটি বহুসংস্কৃতির ব্রিটিশ সমাজের ঐক্যের প্রতীক হিসেবেই দাঁড়িয়ে আছে আলতাব আলী পার্কে। আমরা এখানে এসে ঐক্য ও সংহতির পে ও অপশক্তির বিরুদ্ধে শপথ উচ্চারণ করি।
আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে শহীদমিনারে আসতে সবার প্রতি আহবান জানিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, শহীদমিনারে আমাদের বিশাল সমাগমটি বিভেদ ও বিভক্তি সৃষ্টিকারী অশুভ শক্তির জন্যে একটি সতর্ক সংকেত হিসেবেই কাজ করবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৪ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১১
Link to article
Syed Anas Pasha
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Popular Posts
-
বৌদ্ধদের উপর হামলার প্রতিবাদে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ বক্তব্য রাখছেন একজন ভিক্ষু বক্তব্য রাখছেন বৌদ্ধিষ্...
-
Link to Article মঈনুদ্দিনের বিচার দাবিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলীপী
-
বিএনপিকে অর্থ দেওয়ার কথা স্বীকার সাবেক আইএসআই প্রধানের সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন : ১৯...
-
Syed Anas pasha, London Correspondent banglanews24.com LONDON: Senior vice-chairman of BNP Tarrique Rahaman asserted that the next ...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী- ছবি: মনিরুজ্জামান সামি ...
-
Amnesty for probe into Sylhet deaths London Correspondent banglanews24.com DHAKA: Amnesty International demanded investigation in...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন: যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতের মদদপুষ্ট হেফাজতি ভোটের কথ...
-
UK court awards 9 men, including 6 Bangladeshis Syed Anas Pasha, London Correspondent banglanews24.com LONDON: A British Court award...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন: মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশের...
0 comments:
Post a Comment