লন্ডন: লন্ডনে এবার নতুন কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক গোষ্ঠী। নতুন এই কৌশলে তারা ব্যবহার করছে মহাজোটভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টির সাবেক কেন্দ্রীয় ও বর্তমানে যুক্তরাজ্য শাখার প্রবীণ নেতা জগলুল হোসেনকে। তাদের সমর্থন দিচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। নতুন এই কৌশলে লন্ডনে চিকিৎসাধীন বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও কলকাটি নাড়ছেন বলে জানা গেছে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে।
এ নিয়ে লন্ডনে বসবাসরত ওয়ার্কাস পার্টির নেতাকর্মীসহ মুক্তিযুদ্ধের পরে শক্তিগুলোর মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
মঙ্গলবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য শাখা আয়োজিত আলোচনা সভার বক্তাদের বক্তব্যে এই ক্ষোভ ফুটে উঠে।
মুক্তিযুদ্ধের পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই আলোচনা সভায় যুদ্ধাপরাধীদের পাবলম্বনকারী ওয়ার্কার্স পার্টির এই নেতাকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বয়কট করার ঘোষণাও দেওয়া হয়।
জগলুল হোসেনের রাজনৈতিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি থেকেও তাকে বহিস্কারের দাবি উঠেছে সর্বমহলে।
বর্তমান সরকার মতায় আসার পর থেকেই ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা জগলুল হোসেন মাঝে মধ্যে সরকার ও ভারতবিরোধী বক্তব্য দিয়ে মিডিয়ার দৃষ্টিতে আসতে থাকেন। কিন্তু সম্প্রতি ’৭১ এ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার দায়ে অভিযুক্ত লন্ডনে প্রবাসী চৌধুরী মঈনুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত সভা সেমিনারে জগলুল হোসেনের মহাজোট সরকার ও ভারতবিরোধী বক্তব্য কমিউনিটিতে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে।
মহাজোটভুক্ত একটি দলের নেতা হয়েও কিভাবে জগলুল হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে সরকার বিরোধীদের সাথে হাত মেলান তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
শুধু তাই নয়, জামায়াতে ইসলামির ইউরোপীয় সংস্করণ নামে পরিচিত একটি সংগঠন, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীরসহ অন্যান্য কট্টর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলের সরকারবিরোধী তৎপরতায়ও তার জোরালো অবস্থান যুক্তরাজ্য ওয়ার্কার্স পার্টির নেতাকর্মীদের জন্য তৈরি করেছে এক বিব্রতকর অবস্থা।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে বিএনপিসহ যুদ্ধাপরাধী সমর্থক মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলগুলোর নেতৃস্থানীয়দের এক গোপন বৈঠক গত মাসের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাজ্য বিএনপির এক নেতার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে।
তারেক রহমানের পরামর্শে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সরকারবিরোধী প্রচারণার নতুন কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে ঐক্যমত্য পোষণ করা হয় যে, দেশের বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের প্রচার প্রপাগান্ডা খুব একটা প্রভাব রাখছে না। নিকট অতীতে লন্ডনে দল ও সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের করা মন্তব্য নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, সম্ভব হলে সরকার সমর্থক কোনো দলের নেতৃস্থানীয় কোনো নেতাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকার বিরোধী প্রচারণায় ব্যবহার করতে হবে।
আর তখনই জামায়াতের ইউরোপীয় সংস্করণের একজন নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় চীনপন্থি হিসেবে পরিচিত ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান নেতা জগলুল হোসেনের নাম প্রস্তাব করেন নতুন এই প্রচারণা কৌশলের নায়ক হিসেবে।
বৈঠকের বিস্তারিত সিদ্ধান্ত তারেক রহমানকে অভিহিত করা হয়। জগলুল হোসেনকেও তারেক রহমানের প থেকে ‘দেশ বাঁচানোর’ এই আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহবান জানানো হয়।
কট্টর ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত জগলুল হোসেন ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এরপর শুরু হয় তার দৌড়ঝাঁপ। যোগাযোগ শুরু হয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে। স্মার্ট ও বাগ্মী এই নেতা অভিযোগ করেন, ভারতের নির্দেশে বর্তমান সরকারের বিরোধী দল দমন নীতি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নামে আয়োজিত সভা সেমিনারেও বক্তব্য রাখতে থাকেন তিনি।
ওইসব সেমিনারে জগলুল হোসেন যুদ্ধাপরাধের নামে জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা জানান।
তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত জামায়াত নেতা নিজামী, সাঈদী বা আলী আহসান মোজাহিদ কারো বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ নেই। তাই তাদের যুদ্ধাপরাধী বলা যাবে না।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমকে বর্তমান সরকারের ভণ্ডামী বলে উল্লেখ করে মি. হোসেন বলেন, ‘স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তৎকালীন সরকারের করা যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় কোনো বেসামরিক লোকের নাম ছিলো না।’
অভিযোগ উঠেছে, কোনো একটি সভায় নাকি ‘৭১ এর ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যা সম্পর্কেও আপিত্তকর মন্তব্য করেছেন জগলুল হোসেন।
তিনি এমন কথাও বলেছেন, ‘ওই গণহত্যায় পাকিস্তানি বাহিনী জড়িত নয়, পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতর্কিত করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীই এটি করেছে।’
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, মৌলবাদী গোষ্ঠী সরকারকে বিব্রত করতে জগলুল হোসেনকে দিয়ে তেল-গ্যাস রায় বামপন্থিদের আন্দোলনকেও সরকার বিরোধী তৎপরতায় বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছেন।
কিন্তু এদের এই পরিকল্পনার কথা আগেই প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় তেল-গ্যাস আন্দোলনের ঢাকাস্থ কেন্দ্রীয় নেতারা সতর্ক হয়ে যান।
গত সপ্তাহে লন্ডনে এশিয়া এনার্জির এজিএম চলাকালে তেল গ্যাস রা কমিটির উদ্যোগে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। যেহেতু এই বিক্ষোভ বিদেশি মিডিয়ার চোখে পড়বে তাই এটিকেও সরকার বিরোধী হিসেবে পরিচিত করার অপচেষ্টা করে মৌলবাদীরা।
জগলুল হোসেনের পরিচয়ের আগে যেহেতু বামপন্থি লাগানো, সেহেতু এই আন্দোলনেও তারা জগলুল হোসেনকে ব্যবহারের চেষ্টা করে।
কিন্তু ঢাকায় এই ষড়যন্ত্রের খবর পৌঁছে যায় তেল-গ্যাস রা জাতীয় কমিটির নেতাদের কাছে। তারা লন্ডন কমিটির কাছে জরুরি বার্তা পাঠান যাতে জগলুল হোসেনকে এই বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার সুযোগ না দেওয়া হয়।
শেষমেষ কমিউনিটিতে মৌলবাদীদের লোক বলে পরিচিত ওয়ার্কার্স পার্টির এই নেতা আর এশিয়া এনার্জিবিরোধী বিক্ষোভে যেতে পারেননি।
এদিকে, বিতর্কিত ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে জগলুল হোসেন বাংলানিউজকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, তিনি তার বর্তমান ভূমিকাকে সঠিক বলেই মনে করেন।
উল্টো নিজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভোট জালিয়াতির মধ্য দিয়েই বর্তমান সরকার মতায় এসেছে। এ নির্বাচনে জনগণের ভোটের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।’
আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির জোটভুক্ত হওয়াও সঠিক হয়নি বলে দাবি করে জগলুল হোসেন বলেন, ‘ রাশেদ খান মেননের বর্তমান ভূমিকা জনস্বার্থবিরোধী।’
মেননের নির্বাচনী ফলাফল নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
নিজামী, সাঈদী, মুজাহিদসহ জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধী বলতে নারাজ ওয়ার্কার্স পার্টির এই নেতা বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। কিন্তু এখনও কোনো প্রমাণ দাখিল করা হয়নি।’
জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তার অবৈধ ও অমানবিক উল্লেখ করে জগলুল হোসেন বলেন, ‘আইন কানুনের তোয়াক্কা না করেই সরকার তাদের গ্রেপ্তার করেছে। আর এসব কিছু হচ্ছে ভারত ও আমেরিকার নির্দেশে।’
লন্ডনে বসবাসরত বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক হিসেবে অভিযুক্ত চৌধুরী মঈনুদ্দিনকেও দোষী বলতে নারাজ মহাজোটভুক্ত দলের এই নেতা।
তিনি বলেন, ‘চৌধুরী মঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধেও বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রমাণ আসেনি।’
আওয়ামী লীগকে ভারতের তল্পিবাহক রাজনৈতিক দল উল্লেখ করে জগলুল হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ আজ অরতি।’
বিভিন্ন সভা সেমিনারে দেশবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেমিনারগুলোতে আমি যা বিশ্বাস করি তাই বলেছি, অন্যান্য বক্তার বক্তব্য সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই।’
বিষয়টি নিয়ে লন্ডন থেকে টেলিফোনে রাশেদ খান মেননের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের কাছেও অভিযোগ এসেছে। পার্টি ফোরামে আলোচনা করে আমরা এ বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১০
Link to Article
Syed Anas Pasha
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Popular Posts
-
বৌদ্ধদের উপর হামলার প্রতিবাদে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ বক্তব্য রাখছেন একজন ভিক্ষু বক্তব্য রাখছেন বৌদ্ধিষ্...
-
Link to Article মঈনুদ্দিনের বিচার দাবিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলীপী
-
বিএনপিকে অর্থ দেওয়ার কথা স্বীকার সাবেক আইএসআই প্রধানের সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন : ১৯...
-
Syed Anas pasha, London Correspondent banglanews24.com LONDON: Senior vice-chairman of BNP Tarrique Rahaman asserted that the next ...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী- ছবি: মনিরুজ্জামান সামি ...
-
Amnesty for probe into Sylhet deaths London Correspondent banglanews24.com DHAKA: Amnesty International demanded investigation in...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন: যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতের মদদপুষ্ট হেফাজতি ভোটের কথ...
-
UK court awards 9 men, including 6 Bangladeshis Syed Anas Pasha, London Correspondent banglanews24.com LONDON: A British Court award...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন: মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশের...
0 comments:
Post a Comment