পূর্ব লন্ডনের ওয়াটার লিলি ব্যাংকুয়েট হল থেকে : ‘বাঙালি জাতির প্রতি আমার শ্রদ্ধার শেষ নেই। নিজ মাতৃভাষা রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও আমরা আইরিশরা যখন ব্যর্থ হই, তখন বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালিরা সেই আন্দোলনে হয় বিজয়ী।’ এ যেন নিজ মাতৃভাষা রায় ব্যর্থ, এক আইরিশ নাগরিকের বেদনাঘন উক্তি এটি।
হৃদয়ে রক্তক্ষরণের তীব্র বেদনা আর নিজের মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখার ব্যর্থতার গ্লানি ভুলতে এভাবেই বাংলা ও বাঙালির গৌরব একুশের বন্দনা করলেন আইরিশ নাগরিক ব্যারিস্টার নোরা শরিফ। তাঁর আবেগমথিত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলো এক মাতৃভাষাপ্রেমিকের হৃদয়ের আকুলতা, সোমবার লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের একুশে আলোচনা অনুষ্ঠানে।
২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবস নিজ মাতৃভাষার প্রতি দুর্বল এক আইরিশের মধ্যে যে কতটুকু প্রভাব রাখছে, তারই প্রমাণ একুশের এই আলোচনাসভা। বাঙালি নারীর চিরায়ত পোশাক শাড়ি পরে এলেন ব্যারিস্টার নোরা। ইংরেজির আগ্রাসনে তাঁর মাতৃভাষা ‘আইরিশ গেইলিক’-এর বিলুপ্তির মর্মস্পর্শী স্মৃতিচারণও করলেন নোরা বাংলাভাষায়। তখন উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে তখন নেমে এসেছিল পিনপতন নীরবতা।
ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ডঃ সাইদুর রহমান খানের সভাপতিত্বে এবং প্রেস মিনিস্টার রাশেদ চৌধুরীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এই আলোচনাসভায় আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাবেক ব্রিটিশ এমপি ও সর্বইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি মাইকেল বার্ন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রোশানারা আলী, লন্ডন ইম্পেরিয়েল কলেজের অধ্যাপক মোখলেছুর রহমান, প্রবীণ রাজনীতিক সুলতান শরীফ, আলহাজ সামসুদ্দিন খান, লন্ডন বাংলা প্রেসকাবের সভাপতি মোহাম্মদ বেলাল আহমেদ, সাপ্তাহিক জনমত-এর প্রধান সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশা, সাংবাদিক ও আবৃত্তিকার উদয় শঙ্কর দাশ, ডেপুটি হাইকমিশনার আল্লামা সিদ্দিকী এবং ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি মাহাথির পাশা। অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মণির বাণী পড়ে শোনানো হয়।
’৭১ এ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বিদেশি সংগঠক ব্যারিস্টার নোরা শরীফ একজন আইরিশ নাগরিক। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনেও রয়েছে তাঁর সরব সম্পৃক্ততা। এ মুহূর্তে তিনি ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে রাখছেন বলিষ্ঠ ভূমিকা। এক সময়ের শিক্ষক, বর্তমানে খ্যাতিমান এই আইনজীবী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার লক্ষ্যে আইনের খুঁটিনাটি পর্যালোচনায় এখন সময় ব্যয় করছেন বেশি।
সোমবার লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত শাড়ি পরে উপস্থিত হওয়া নোরা বক্তব্য রেখেছেন বাংলায়। বলেছেন ‘বাঙালি জাতীর প্রতি আমার শ্রদ্ধার শেষ নেই। নিজ মাতৃভাষা রার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও আমরা আইরিশ’রা যখন ব্যর্থ হই, তখন বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালিরা সেই আন্দোলনে হয় বিজয়ী। শুধু তাই নয়, তাদের এই অর্জনের গৌরবগাথা আজ তারা বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করছে’।
ব্যারিস্টার নোরা বলেন, `বাঙালির একুশ আমার সান্ত্বনা পাওয়ার জায়গা, আমাদের পরাজয়ের গ্লানি ভুলে থাকার অবলম্বন। যখন দেখি আজকের আইরিশ প্রজন্ম নিজ মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না, অথবা বলে না তখন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। আর এই রক্তক্ষরণের বেদনা ভুলতে ছুটে আসি বাঙালির একুশের কাছে।`
আইরিশ নাগরিক নোরা শরিফ তার ছোট্ট বয়সের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার বাবা বলেছেন, তারা যখন স্কুলে যেতেন তখন তাদের প্রতিটি ছেলেমেয়ের জন্যে একেকটি কাঠের টুকরা বরাদ্দ রাখা হতো। স্কুলে পাঠদানের সময়ের বাইরে বিরতির সময় তারা সহপাঠীদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় কে কয়বার ইংরেজির পরিবর্তে গেইলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন তা টুকে রাখা হতো এই কাঠের টুকরায়। স্কুল শেষে প্রধান শিক্ষক আইরিশ ভাষা ব্যবহারের সেই সংখ্যানুপাতে তাদের শাস্তি দিতেন। যে যত বেশি আইরিশ ব্যবহার করতেন তার তত বেশি শাস্তি ভোগ করতে হতো।’
ব্যারিস্টার নোরা বলেন, আমাদের অভিভাবকরাও ছিলেন এ বিষয়ে অসহায়। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি আমাদের ভাষা টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু পারিনি। আজ আইরিশ ভাষায় কথা বলার জনসংখ্যা খুবই কম, দিনে দিনে তা নিঃশেষ হওয়ার পথে। অথচ এই ভাষায় আমাদেরও ছিল একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, আলোকিত একটি অতীত। আমরা আমাদের ভাষা সংস্কৃতির সমৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হয়েছি, আর বাঙালিরা বুকের রক্ত দিয়ে এই সংগ্রামে হয়েছে সফল। এজন্যেই বাঙালি জাতিগোষ্ঠী আমার শ্রদ্ধার্হ, একুশ আমার সান্ত্বনা পাওয়ার অবলম্বন। নিজ ভাষার প্রতি যখনই হৃদয়ে আমি আকুলতা অনুভব করি, তখনই ছুটে আসি বাঙালির একুশের কাছে।
এমপি রোশনারা আলী প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যেই বাঙালির একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই তাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার রয়েছে। এটি এক মানবাধিকার। আর এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালিরাই একমাত্র জাতি যারা তাজা প্রাণ বিলিয়ে,নিজেদের রক্তে রাঙিয়েছে প্রিয় স্বদেশভূমি। স্কুল-জীবনের স্মৃতিচারণ করে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ এমপি বলেন, ক্লাশের বাইরে সিলেটি ভাষায় কথা বলতাম বলে বাংলার শিক্ষকরা আমাদের দিকে আড় চোখে তাকাতেন, ছোটো বাচ্চাদের প্রতি তাদের এই আচরণ কতটুকু ভুল ছিল তা এখন বুঝতে পারি।`
রোশনারা আলী বলেন,` ব্রিটেনে অন্যান্য ভাষার সাথে সিলেটিও আজ একটি স্বীকৃত ভাষা। আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে রোশনারা নিজেকে একজন ব্রিটিশ, একজন বাঙালি এবং সর্বশেষে একজন সিলেটি বলে উল্লেখ করে বলেন, `ছেলেমেয়েদের প্রমিত বাংলা আমাদের অবশ্যই শেখাতে হবে। তবে পাশাপাশি তাঁর মাতৃভাষায় ( আঞ্চলিক ভাষায়) কথা বলাও নিরুৎসাহিত করা যাবে না। এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। ভাষা শেখাতে গিয়ে বাচ্চাদের উপর এমন মানসিক চাপ প্রয়োগ করা ঠিক নয়। এমনটি করা হলে তার শিশুমনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ঘরে যে যত ভুল বাংলায়ই কথা বলুক, তাতে তাদের তিরস্কার না করে বন্ধুর মতো আচরণ করে প্রমিত ভাষা ও এর উচ্চারণ বোঝাতে হবে।`
এ প্রসঙ্গে রোশনারা বলেন, `ভুল বাংলা বলার জন্য তাদের তিরস্কার করা উচিত হবে না। এটা করা হলে পরে ভয়ে সে আর প্রমিত বাংলায় কথা বলতেই চাইবে না। `
বক্তব্যের শুরুতে রোশনারা শ্রোতাদের কাছে প্রমিত বাংলা বলতে না পারার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, `আমি সিলেটি ভাষাটি জানি। কিন্তু আজকের এই বাংলাভাষায় পরিপক্ষ সুধীজনের সামনে সে ভাষায় না বলে ইংরেজিতেই কথা বলতে চাই।`
সাবেক ব্রিটিশ এমপি মাইকেল বার্ন তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের তার মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণ করে বলেন, ’৭১ এর মে মাসের শেষের দিকে ভারতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তখন দেখেছি তাদের মুক্তির কী দুর্বার আকাঙ্ক্ষা। তখন যে চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল তার শেকড় প্রোথিত বাঙালির ভাষা আন্দোলনের মধ্যে। প্রবীণ এই সাবেক ব্রিটিশ এমপি ’৭২ সালে বাংলাদেশে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের স্মৃতিচারণও করেন তাঁর বক্তৃতায়।
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে পরিবেশিত হয় এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
22 Feb 2011 10:50:05 PM Tuesday BdST
Link to Article
Syed Anas Pasha
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Popular Posts
-
বৌদ্ধদের উপর হামলার প্রতিবাদে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ বক্তব্য রাখছেন একজন ভিক্ষু বক্তব্য রাখছেন বৌদ্ধিষ্...
-
Link to Article মঈনুদ্দিনের বিচার দাবিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলীপী
-
বিএনপিকে অর্থ দেওয়ার কথা স্বীকার সাবেক আইএসআই প্রধানের সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন : ১৯...
-
Syed Anas pasha, London Correspondent banglanews24.com LONDON: Senior vice-chairman of BNP Tarrique Rahaman asserted that the next ...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী- ছবি: মনিরুজ্জামান সামি ...
-
Amnesty for probe into Sylhet deaths London Correspondent banglanews24.com DHAKA: Amnesty International demanded investigation in...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন: যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতের মদদপুষ্ট হেফাজতি ভোটের কথ...
-
UK court awards 9 men, including 6 Bangladeshis Syed Anas Pasha, London Correspondent banglanews24.com LONDON: A British Court award...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন: মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশের...
0 comments:
Post a Comment