লন্ডন: ১৯৭৫ সালে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সংঘটিত সিপাহী বিপ্লবে ইন্ধন দানের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে বিশিষ্ট রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ডাচ নাগরিক ডঃ পিটার কাস্টার। গোপন সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরের বিচারকে হাইকোর্ট সম্প্রতি অবৈধ ঘোষণা করার পর বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন পিটার কাস্টারের ইন্ধনেই কর্নেল তাহের বিপ্লবের নামে শত শত সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছিলেন। আর এই অপরাধেই তাহেরের মৃত্যুদন্ড হয়।
উল্লেখ্য, ’৭৫ সালে বিপ্লবে ইন্ধনের অভিযোগে ড. পিটার কাস্টার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন।
মির্জা ফখরুলের এই মন্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে বাংলানিউজ ডঃ পিটার কাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রতিক্রিয়ায় ড. কাস্টার বলেন, ‘এমন অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে থাকলে তা হবে সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। আমাকে জড়িয়ে বিএনপি’র এমন অভিযোগের খবরে আমি খুবই মনক্ষুন্ন হলাম।’
ডঃ পিটার কাস্টার বাংলানিউজকে দেওয়া নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তার বিস্তারিত বক্তব্য তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের হাইকোর্টের রায়ে কর্নেল তাহেরের বিচার অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে ডঃ কাস্টার বলেন, ‘বাংলাদেশের হাইকোর্টের দেওয়া এই রায় ঐতিহাসিক। গণতন্ত্রের পক্ষে এটি এক মাইলফলক। সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরের এই গোপন বিচার শুধু হাইকোর্ট নয়, বাংলাদেশের জনগণের চোখেও ছিল এক অবৈধ বিচার ।’
’৭৫ এর ঘটনাবহুল ঐসব দিনের স্মৃতিচারণ করে পিটার বলেন, ‘তাহেরের বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার সময় আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলাম। যে বিচারক কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে রায় দেন, তিনি ছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি আর্মির একজন দালাল। বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন সাহসী সেক্টর কমান্ডারকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করবে পাক আর্মির একজন দালাল, এটি কোনোভাবেই আমরা মেনে নিতে পারছিলাম না।’
পিটার কাস্টার বলেন, ‘একটি অবৈধ ও ষড়যন্ত্রমূলক বিচারে কর্নেল তাহেরের মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে দ-িত করার মধ্য দিয়ে বাঙালির ললাটে কলঙ্কতিলক এঁকে দিয়েছিলো তৎকালীন সামরিক সরকার। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর বাংলাদেশের হাইকোর্টের দেওয়া সাম্প্রতিক রায়ে সেই কলঙ্কমোচন হলো। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা।‘
অবশ্য হাইকোর্টের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও, রায়ের খবর নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া যেভাবে সরব হয়েছে তাতে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন একই ঘটনায় কারাবরণকারী এই আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘এই রায়কে কেন্দ্র করে কর্নেল তাহেরের রাজনীতি ও বিপ্লবী চিন্তাচেতনা মিডিয়ায় যেভাবে আলোকপাত করা উচিত ছিল সেটি কিন্তু হয়নি। ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক মতবাদের পক্ষে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে জোয়ার উঠেছিল, বিপ্লবী কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার পর এই জোয়ারে ভাটার টান লাগে।’
পিটার কাস্টারের মতে, ‘তাহেরের বিচার অবৈধ ঘোষিত হওয়ার পর বিপ্লবী রাজনীতির মরানদীতে আবারও বান ডাকে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়। আদালতের রায়তো বলেই দিলো তাহের কোনও অন্যায় করেননি, সঠিক পথেই ছিলেন। তাহলে তাঁর এই বিপ্লবী মতবাদ প্রতিষ্ঠায় ’৭২-’৭৫ এর মতো আবারও উদ্যমী হতে তাহের অনুসারীদের বাধা কোথায়?’
‘তাহেরের বিপ্লব কেন ব্যর্থ হলো?’ --বাংলানিউজের এপ্রশ্নের জবাবে ’৭৫ এর সেই ঘটনাবহুল রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষক পিটার কাস্টার বলেন, ‘সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে তাহেরেরে প্রভাব ছিল ঠিকই, তাদের মনোভাবও সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন তাহের। কিন্তু সৈন্যদের বাইরে সাধারণ জনগণকে এই বিপ্লবের পক্ষে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হন তাহেরের তৎকালীন রাজনৈতিক সহকর্মীরা। তাহের সেনাবাহিনীর মধ্যে তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলেও জনগণের মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।’
‘মানুষের আবেগ অনুধাবন করা খুব সহজ কাজ নয়’ বলে মন্তব্য করে পিটার কাস্টার বলেন, ‘সেই সময় বিপ্লবের পক্ষে সাধারণ মানুষের খুব একটা সমর্থন যে ছিল না, এটি অনুধাবন করতে সক্ষম হননি তাহেরের রাজনৈতিক সহকর্মীরা। এটি অনুধাবন করার দায়িত্ব কিন্তু তাহেরের ছিল না। তাছাড়া তৎকালীন বাম ও সামজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোও তাহেরের এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে সমর্থন দেয়নি।’
’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া সাম্প্রতিক উদ্যোগকে স্বাগত জাানিয়ে এই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব এই বিচারটি সম্পন্ন করা উচিত।’
‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায়িত্ব দিয়েই বর্তমান সরকারকে নতুন প্রজন্ম ক্ষমতায় পাঠিয়েছে‘ বলে মন্তব্য করে পিটার কাস্টার বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে তরুণ প্রজন্ম অবিকৃত, সত্য ইতিহাস খুঁজছে, জানছে। সামরিক বা অগণতাান্ত্রিক শাসন এখন আর আগের মতো জনগণের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কোনও অন্যায় বা মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড করে আর কেউ পার পাবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে তরুণ প্রজন্মের অবস্থান তারই প্রমাণ।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক, মানবাধিকারকর্মী ডঃ পিটার কাস্টার ১৯৭৫ সালে কর্ণেল তাহেরের সাথে একই অভিযোগে কারাবরণ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত একটি ডাচ দৈনিকের মূল প্রতিবেদক হিসেবে তিনি ঢাকায় কাজ করছিলেন। বাংলাদেশ ও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ও নিউজ জার্নালে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির উপর নিয়মিতই তিনি লিখে থাকেন। নেদারল্যান্ডের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজ-এর ফেলো পিটার কাস্টার ২০০৭ সাল থেকে ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা’ বিষয়ে একাডেমিক গবেষণাকর্মে নিয়োজিত আছেন।
10 Apr 2011 05:18:33 PM Sunday BdST
Link to Article
Syed Anas Pasha
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Popular Posts
-
বৌদ্ধদের উপর হামলার প্রতিবাদে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ বক্তব্য রাখছেন একজন ভিক্ষু বক্তব্য রাখছেন বৌদ্ধিষ্...
-
Link to Article মঈনুদ্দিনের বিচার দাবিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলীপী
-
বিএনপিকে অর্থ দেওয়ার কথা স্বীকার সাবেক আইএসআই প্রধানের সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন : ১৯...
-
Syed Anas pasha, London Correspondent banglanews24.com LONDON: Senior vice-chairman of BNP Tarrique Rahaman asserted that the next ...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী- ছবি: মনিরুজ্জামান সামি ...
-
Amnesty for probe into Sylhet deaths London Correspondent banglanews24.com DHAKA: Amnesty International demanded investigation in...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন: যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতের মদদপুষ্ট হেফাজতি ভোটের কথ...
-
UK court awards 9 men, including 6 Bangladeshis Syed Anas Pasha, London Correspondent banglanews24.com LONDON: A British Court award...
-
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লন্ডন: মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশের...
0 comments:
Post a Comment