ড. কামাল হোসেন
বিশ্বাসের জায়গা থেকে বঞ্চিত করবেন না, প্লিজ
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
’৯০ দশকের শেষ দিকে লন্ডনে চিকিৎসাধীন ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে লেখক |
সমাজের চরম অবক্ষয়ের সময়ও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বিশেষ থাকেন, যাদের ওপর মানুষ বিশ্বাস রাখতে ভরসা পান, আস্থা রেখে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে চান।বাংলাদেশে সেই বিশ্বাস ও আস্থা রাখার সীমানাটি কি দ্রুতই কমে আসছে?
সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের করা একটি মন্তব্যে এমনি একটি প্রশ্ন মোটা দাগে উঠে এসেছে রাজনীতি সচেতন বাংলাদেশের মানুষের সামনে। শনিবার নীলফামারী সার্কিট হাউসে এক মতবিনিময় সভায় ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা কঠিন’। আর ‘দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা উচিত নয়’।
ড. কামাল হোসেন, যাকে অনেকে ‘জাতির বিবেক’ বলতে আনন্দ পান। এই তালিকায় আমি নিজেও যে নেই, তা কিন্তু নয়। নিজের আজকের নতুন এই উপলব্দির সময় ড. কামাল আমাকে চিনবেন কি না, আমি জানি না, কিন্তু এক সময় তার সঙ্গে ভালোই পরিচিত ছিলাম। আদর্শবাদী আইকন হিসেবে মূল্যায়ণ করে তার নেতৃত্বে রাজনীতির মাঠেও ছিলাম বেশ কিছু দিন।
পুরো ৮০’র দশক থেকে শুরু করে ৯০ দশকের প্রথম অর্ধাংশের প্রথম পর্যায় পরযন্ত বাম রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম খুবই সক্রিয় ভাবে। এরপর ড. কামাল হোসেনের গণতান্ত্রিক ফোরাম থেকে গণফোরাম। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে বিশেষ করে ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর রাজনীতি যখন সুস্থতা হারানোর পর্যায়ে তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম আওয়ামী লীগ বিএনপি’র বাইরে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ একটি বিকল্প রাজনৈতিক সংগঠনের, যে সংগঠনটি কোনো কারণে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে।
আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যেন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তি বা তাদের দোসরদের হাতে চলে না যায়, এমনই একটি আকাঙ্খা থেকেই আমার মতো অনেকের এমন স্বপ্ন দেখা। নিজে বাম রাজনৈতিক দল ন্যাপ বা গণতন্ত্রী পার্টির সমর্থক হলেও এটি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম যে, আওয়ামী লীগের বিকল্প হয়ে ওঠা এ দলগুলোর জন্যে আর সম্ভব নয়।
আর তাইতো মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে, এমন একটি বিকল্প রাজনৈতিক প্লাটফরমের স্বপ্ন দেখতাম। আওয়ামী লীগের অবহেলার কারণে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ হিসেবে ড. কামাল যখন গণতান্ত্রিক ফোরাম থেকে গণফোরাম গঠনের উদ্যোগ নিলেন, তখন সেই আকাঙ্খিত বিকল্প রাজনৈতিক প্লাটফরমের স্বপ্ন অনেকটা বাস্তব হয়েই আমার মতো অনেককেই হাতছানি দিতে থাকে। তখনকার রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রী পার্টি থেকে পদত্যাগ করে যোগদান করি নবগঠিত গণফোরামে।
কিন্তু কিছু দিন যেতেই বুঝতে পারি, বিকল্প শক্তির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। ১৯৯৫ সালে প্রথম ব্রিটেন আসার পরও বিকল্প শক্তির স্বপ্ন পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারিনি। ফ্রিকুয়েন্ট আন্তর্জাতিক ট্র্যাভেলার ড. কামাল লন্ডন এলেই ছুটে যেতাম তার কাছে। জানতে চাইতাম, আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো খবর আছে কি না।
কিন্তু এক পর্যায়ে বুঝতে পারি, নিজের আইন ব্যবসা নিয়ে ড. কামাল যতটুকু আন্তরিক, একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টিতে ততোটুকু নন। আস্তে আস্তে রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নেই নিজেকে।
কিন্তু বিশ্বাসের জায়গা, ভরসার জায়গা হিসেবে ড. কামালকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে লন্ডনে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হতো। ১/১১ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা মূখর হলেও আমার মতো অনেকেই কিন্তু বিশ্বাসের জায়গা হিসেবে তার ওপর আস্থা রাখার চেষ্টা করেছি।
পারিবারিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করেই আমার বেড়ে ওঠা। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা ছিলেন তৎকালীন ন্যাপ’র জেলা পর্যায়ের একজন নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। যুদ্ধে শহীদ আমার দুই খালু চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে দুই খালাকে বৈধব্য বেশে সাদা শাড়ি পরতে দেখে আসছি সেই শৈশব থেকে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাবার সঙ্গে নানা বাড়িতে যখন বেড়াতে যেতাম, তখন দেখতাম পিতা হারানো আমার খালাতো ভাই-বোনরা কিভাবে লোভী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো আমার বাবার দিকে।
শৈশবের ওই সব স্মৃতিকাতরতার কারণেই আমি আজ ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিদারদের অন্যতম একজন। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার পর তাদের শনৈ শনৈ বিস্তৃতি আমার মতো অনেককেই শঙ্কিত করে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অনেক ব্যর্থতা এই শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
আর তাই বার বার স্বপ্ন দেখি, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির। ’৯০ দশকের প্রথম দিকে ড. কামালকে নিয়ে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। ড. কামাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতেন, অসাম্প্রদায়িক সমাজের কথা বলতেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলতেন। মনে করতাম, তাকে দিয়েই সম্ভব।
কিন্তু ব্যক্তিগত জেদাজেদি আদর্শিক রাজনীতিকেও অনেক সময় পেছনে ফেলে দেয়, একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আজ থেকে বছর দুয়েক আগে লন্ডনে ড. কামালের একটি মতবিনিময় সভায় গিয়ে প্রথম বুঝলাম। যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম তখন মাত্র শুরু হচ্ছে। জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী তখনও জেলের বাইরে।
বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানলাম, নিজামী বলেছেন ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার আগে ড. কামাল হোসেনের বিচার করতে হবে। নিজামীর ভাষায়, ’৭৩ এ সিমলা চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টি সুরাহা হয়ে যাওয়ার পর এখন আর এর বিচার করার সুযোগ নেই। এরপরও যদি তা করতে হয়, তাহলে ওই চুক্তিতে সম্মতি দেওয়ার অপরাধে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. কামালের বিচার করতে হবে আগে। লন্ডনের মতবিনিময় সভায় কামাল হোসেন নিজামীর এই মন্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, এমন আশা নিয়েই গিয়েছিলাম তার অনুষ্ঠানে।
কিন্তু দীর্ঘ বক্তৃতায় বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে সব বিষয়ে আলোচনা করলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুটি নিয়ে কামাল হোসেন কোনো মন্তব্যই করলেন না। বাধ্য হয়ে তার বক্তৃতা শেষে এই ইস্যুতে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তাও তিনি এড়িয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত বললাম, নিজের বিচার নয়, নিজামীতো আপনার বিচার চান, আপনি এখন কি বলবেন। এর উত্তরও এড়িয়ে গেলেন কামাল হোসেন।
অত্যন্ত শক্ড হলাম তাঁর আচরণে। বুঝতে পারলাম, শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে হাসিনা সরকারের নেওয়া জাতীয় দাবি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার উদ্যোগেও ড. কামাল হোসেনের মতো ‘জাতির বিবেক’ এর সমর্থন দিতে কষ্ট হচ্ছে। এ যেন ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’। এই ঘটনার পর থেকে আর দেখা হয়নি কামাল হোসেনের সঙ্গে। লন্ডন এলেও আর দৌঁড়ে যাই না তার কাছে।
শনিবার নীলফামারীতে দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অত্যন্ত কঠিন কাজ বলে করা কামাল হোসেনের মন্তব্য অনেকেই হয়তো নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করবেন। এই মন্তব্যের মাধ্যমে ড. কামাল কি এটি একটি কঠিন কাজ বলে তা বাদ দিয়ে দিতে বলছেন সরকারকে? এই যদি তার মন্তব্যের কারণ হয়, তাহলে দীর্ঘ চল্লিশ বছরেও কেন এই বিচার করতে পারেননি, একজন রাজনীতিক ও বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে এর দায় কি কামাল হোসেন নিজে এড়াতে পারবেন?
’৯০ দশকের প্রথম দিকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, সেই আন্দোলনেতো কামাল হোসেনও ছিলেন অগ্রভাগে। তখনও তো তিনি এই বিচার সম্ভব নয় বলে কোনো নিরাশার কথা জাতিকে শোনাননি। চল্লিশ বছর পর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ যখন বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে, ঠিক এমনি মুহূর্তে কেন কামাল হোসেনের মত ‘জাতির বিবেক’র এই নৈরাশ্যজনক মন্তব্য?
এটি কি শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগ বলেই? না শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বহি:প্রকাশ? আওয়ামী লীগও যে ধূয়া তুলসী পাতা এটি আমরা অনেকেই বলি না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে আওয়ামী লীগের কিছু সংখ্যক নেতার আন্তরিকতা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ আছে।
আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপিতো যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যুদ্ধাপরাধ বিচার বাধাগ্রস্থ করতে মিলিয়ন মিলিয়ন অর্থ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাঠে নেমেছে জামায়াত। ব্রিটিশ আইনজীবীদের মতো অনেক খ্যাতিমান আইনজীবীও আজ নিজেদের প্রফেশনের বাইরে গিয়ে এই অর্থের লোভে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জামায়াতের লবিস্ট হিসেবে কাজে নেমেছেন যুদ্ধাপরাধ বিচারকে বাধাগ্রস্থ করার লক্ষ্য নিয়ে।
এমনি অবস্থায় কামাল হোসেনের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান আইনজীবীর যেখানে প্রয়োজন এই বিচার প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করা, সেখানে তিনি তা না করে করছেন নৈরাশ্যজনক মন্তব্য। এতে লাভবান হচ্ছে কারা?
নীলফামারীতে করা ড. কামালের মন্তব্য জামায়াত সমর্থকরা বিভিন্ন মাধ্যমে যেভাবে ব্যাপক প্রচার করছে তাতেই বোঝা যাচ্ছে কামাল হোসেনের এই মন্তব্যের বেনিফিসিয়ারি কারা।
নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব বা ব্যক্তি বিদ্বেষ যদি কামাল হোসেনের এমন মন্তব্যের কারণ হয়, তাহলে একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এমন মন্তব্যের আগে তার চিন্তা করা উচিত ছিল যে, ড. কামাল শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি নন, দেশের সচেতন একটি অংশের কাছে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের মতো। সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে যে প্রতিষ্ঠানের রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস, যে প্রতিষ্ঠান মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও গণতন্ত্রের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরার সংগ্রাম শুরু করছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহামানবের হাত ধরে। আর এই মন্তব্য যদি রাজনীতিতে তার নতুন উপলব্দি হয়, তাহলে বলতে দ্বিধা নেই যে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শ্বশুর বাড়ি পাকিস্তানের কারাগারে থাকায় মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির সঠিক আত্মত্যাগ সম্পর্কে হয়তো তিনি দ্বিধাহীন ছিলেন না।
ড. কামাল হোসেন মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, এই যুদ্ধে তার কোনো পারিবারিক আত্মত্যাগ আছে কি না, আমার জানা নেই। তবে এটুকু বুঝতে পারি যে, ১৯৪৫ সালে সংগঠিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কোনো নাৎসির সাম্প্রতিক বিচার উদ্যোগে যিনি উৎফুল্ল হন, সেই কামাল হোসেন যখন নিজের দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে চল্লিশ বছর সময়কে অন্যতম বাঁধা হিসেবে চিহ্নিত করেন, তখন বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বাসের জায়গা হিসেবে তার অবস্থানকেই তিনি বিতর্কিত করেন।
জামায়াতের টাকার খেলার কারণে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও। ব্রিটেন এর অন্যতম কেন্দ্র। স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক মানের বিচার এমন সব প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে জামায়াতি টাকার বদৌলতে।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের একজন অতন্দ্র প্রহরী কামাল হোসেনের কাছে প্রশ্ন: স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ফৌজদারি, দেওয়ানিসহ যতো বিচার সম্পন্ন করেছে, ওই গুলো কি নিরপেক্ষ ছিল? যদি তাই হয়, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আজ কেন নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মানের এতো সব প্রশ্ন? আগের বিচার কার্যক্রম বিষয়ে বিচার বিভাগের মান ও নিরপেক্ষতা যেহেতু আন্তর্জাতিক অঙ্গণে কোনো বিতর্ক তোলেনি, সেহেতু ধরে নেওয়া যায়, বাংলাদেশের বিচার সিস্টেম আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ক্ষেত্রে কেন আজ নতুন করে এতো সব পশ্ন?
ড. হোসেন, ব্রিটেনের মতো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের সময় মানুষের পছন্দ থাকে, মূল দুটো বা তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতি। এক দল ব্যর্থ হলে, পরবর্তী নির্বাচনে অন্য দলকে পছন্দ করেন মানুষ। বাংলাদেশে আমার মতো অনেকেরই চাহিদা তো এমনই ছিল। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুটো প্রধান দল রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেদের সফলতা-ব্যর্থতার কারণেই ঘুরে ফিরে ক্ষমতায় আসবে, ক্ষমতাচ্যূত হবে, সাধারণ মানুষের পছন্দের একটি সুযোগ থাকবে, এতটুকুইতো আমাদের চাওয়া। কিন্তু আমার মতো অনেককেই নির্বাচনের সময় বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিতে হয়। আর আওয়ামী লীগও এই শ্রেণীর ভোটারদের এই দুর্বলতার সুযোগ নেয়।
আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপি’র দিকে মুখ ফেরাতে চাইলেই আমরা দেখি, ’৭১ এর ঘাতকরা বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী, আর তখনই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বৈধব্য বেশে সাদা শাড়ি পরিহিত আমার দুই খালার চেহারা। আওয়ামী লীগের ওপর বিরক্ত হয়ে যখন বিএনপি’র দিকে মুখ ফেরাতে চাই, তখনই দেখি, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম রাখতে চায় বিএনপি, দেখি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন বিএনপি নেত্রী!
এমনি অবস্থায় ’৭১ এর স্বজন হারানোর শোক নিয়ে আওয়ামী লীগের শত ব্যর্থতা থাকলেও বিএনপিমুখী হই কিভাবে আপনিই বলুন? আর অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির হর্তাকর্তা আপনারা আওয়ামী লীগের এমন একটি বিকল্পও এতো দিনে তৈরি করতে পারেননি, যার ওপর আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায় ক্ষুব্দ জনগোষ্ঠী নির্ভর করতে পারে। ’৯০ দশকে বিকল্প শক্তির লোভ যখন দেখালেন আপনি, আমরা অনেকেই তো আপনাকে সমর্থন দিয়েছিলাম। কি লাভ হলো। তখনকার শক্তিশালী বাম দল, শোষিত মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে যাদের বিবেচনা করা হতো, সেই কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ’র মতো সংগঠন ভেঙ্গে আপনি গণফোরাম করলেন। আবুল মাল আব্দুল মুহিত, নুরুল ইসলাম নাহিদ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, প্রয়াত সাইফুদ্দিন মানিক, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামসহ অনেক প্রতিথযশা ব্যক্তিই তো আপনাকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
কিন্তু বিনিময়ে আপনি কি দিতে পেরেছেন আমাদের একটি বিকল্প শক্তি? এই দিতে না পারার অপরাধ কি দেশের মানুষের? ড. হোসেন, আপনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর। আপনার অনেক পরামর্শই তিনি বিবেচনায় নিতেন বলে শুনেছি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের শূন্যস্থান পূরণের জন্যে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ একটি বিকল্প শক্তি তৈরিতে পেছন থেকে সহযোগিতার বিষয়ে তাকে যদি পরামর্শ দিতেন, তাহলে আজ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা এই পর্যায়ে আসতো না, বিএনপি’র মতো একটি সাম্প্রদায়িকতা ঘেষা দলেরও জন্ম হতো না। এই যে ব্যর্থতা আপনার মতো রাজনীতিকদের, এর দায়ও কি আমাদের সাধারণ জনগণের?
ব্যক্তি বিদ্বেষের কারণে মৌলিক সব উপলব্দি পেছনে রেখে আজ আপনি নতুন উপলব্দির কথা শোনাচ্ছেন জাতিকে। আপনার নতুন এই উপলব্ধিকে পুঁজি করে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত যে আজ বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে, এটি কি আপনি বুঝতে পারছেন? এই বিষয়টিও আবার আপনাকে নতুন করে উপলব্দি করার অনুরোধ করছি ড. কামাল হোসেন।
ড. হোসেন, বাঙালির বিশ্বাসের জায়গার বড় অভাব। সামান্যতম যাও আছে তা থেকে জাতিকে বঞ্চিত করবেন না প্লিজ। যুদ্ধাপরাধ বিচার ইস্যুতে আপনার মতো আইনজীবীদের সম্পৃক্ত করতে না পারা হাসিনা সরকারের একটি চরম ব্যর্থতা, এটি আমি স্বীকার করি। কিন্তু তাই বলে এই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে করা আপনার কোনো মন্তব্য যুদ্ধাপরাধীদের পালে আরও হাওয়া দেবে, এটি তো আমরা মেনে নিতে পারি না।
জাতীয় কর্তব্য হিসেবেই আপনাকে এই বিচার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ, আপনি যে ‘জাতির বিবেক’, বঙ্গবন্ধুর মতো মহামানবের পথ চলার সঙ্গী ছিলেন আপনি। রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে আপনার গঠনমূলক সমালোচনার আমরাও সমর্থক হতে চাই। কিন্তু প্লিজ, এমন কোনো ভূমিকা নেবেন না, যে ভূমিকার ফলে ’৭১ এর ঘাতককূল শিরোমণি গোলাম আযম যেন আবার ‘অলিকূল শিরোমণি’র খেতাব নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
জনাব কামাল হোসেন, মহাজোটে থেকেও সরকারের কিছু কিছু ব্যর্থতার কারনে আওয়ামী লীগের ওপর খুব একটা খুশি নন, মেনন, ইনুর মতো নেতারা। কিন্তু তারাও তো হাল ছেড়ে দেননি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়েই তারা আছেন মাঠে। মহাজোটের বাইরে থেকেও কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে মাঠ গরম রাখে।
আর আপনি ব্যক্তি বিদ্বেষের কারণে অভিমান করে জাতিকে নতুন নতুন উপলদ্ধির কথা শোনান, যে উপলদ্ধিতে লাভবান হয় যুদ্ধাপরাধীরা, এটি কি ঠিক?
বিষয়টি একটু ভেবে দেখুন, প্লিজ!
বাংলাদেশ সময়: ২১১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১২
সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের করা একটি মন্তব্যে এমনি একটি প্রশ্ন মোটা দাগে উঠে এসেছে রাজনীতি সচেতন বাংলাদেশের মানুষের সামনে। শনিবার নীলফামারী সার্কিট হাউসে এক মতবিনিময় সভায় ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা কঠিন’। আর ‘দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা উচিত নয়’।
ড. কামাল হোসেন, যাকে অনেকে ‘জাতির বিবেক’ বলতে আনন্দ পান। এই তালিকায় আমি নিজেও যে নেই, তা কিন্তু নয়। নিজের আজকের নতুন এই উপলব্দির সময় ড. কামাল আমাকে চিনবেন কি না, আমি জানি না, কিন্তু এক সময় তার সঙ্গে ভালোই পরিচিত ছিলাম। আদর্শবাদী আইকন হিসেবে মূল্যায়ণ করে তার নেতৃত্বে রাজনীতির মাঠেও ছিলাম বেশ কিছু দিন।
পুরো ৮০’র দশক থেকে শুরু করে ৯০ দশকের প্রথম অর্ধাংশের প্রথম পর্যায় পরযন্ত বাম রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম খুবই সক্রিয় ভাবে। এরপর ড. কামাল হোসেনের গণতান্ত্রিক ফোরাম থেকে গণফোরাম। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে বিশেষ করে ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর রাজনীতি যখন সুস্থতা হারানোর পর্যায়ে তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম আওয়ামী লীগ বিএনপি’র বাইরে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ একটি বিকল্প রাজনৈতিক সংগঠনের, যে সংগঠনটি কোনো কারণে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে।
আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যেন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তি বা তাদের দোসরদের হাতে চলে না যায়, এমনই একটি আকাঙ্খা থেকেই আমার মতো অনেকের এমন স্বপ্ন দেখা। নিজে বাম রাজনৈতিক দল ন্যাপ বা গণতন্ত্রী পার্টির সমর্থক হলেও এটি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম যে, আওয়ামী লীগের বিকল্প হয়ে ওঠা এ দলগুলোর জন্যে আর সম্ভব নয়।
আর তাইতো মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে, এমন একটি বিকল্প রাজনৈতিক প্লাটফরমের স্বপ্ন দেখতাম। আওয়ামী লীগের অবহেলার কারণে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ হিসেবে ড. কামাল যখন গণতান্ত্রিক ফোরাম থেকে গণফোরাম গঠনের উদ্যোগ নিলেন, তখন সেই আকাঙ্খিত বিকল্প রাজনৈতিক প্লাটফরমের স্বপ্ন অনেকটা বাস্তব হয়েই আমার মতো অনেককেই হাতছানি দিতে থাকে। তখনকার রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রী পার্টি থেকে পদত্যাগ করে যোগদান করি নবগঠিত গণফোরামে।
কিন্তু কিছু দিন যেতেই বুঝতে পারি, বিকল্প শক্তির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। ১৯৯৫ সালে প্রথম ব্রিটেন আসার পরও বিকল্প শক্তির স্বপ্ন পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারিনি। ফ্রিকুয়েন্ট আন্তর্জাতিক ট্র্যাভেলার ড. কামাল লন্ডন এলেই ছুটে যেতাম তার কাছে। জানতে চাইতাম, আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো খবর আছে কি না।
কিন্তু এক পর্যায়ে বুঝতে পারি, নিজের আইন ব্যবসা নিয়ে ড. কামাল যতটুকু আন্তরিক, একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টিতে ততোটুকু নন। আস্তে আস্তে রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নেই নিজেকে।
কিন্তু বিশ্বাসের জায়গা, ভরসার জায়গা হিসেবে ড. কামালকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে লন্ডনে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হতো। ১/১১ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা মূখর হলেও আমার মতো অনেকেই কিন্তু বিশ্বাসের জায়গা হিসেবে তার ওপর আস্থা রাখার চেষ্টা করেছি।
পারিবারিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করেই আমার বেড়ে ওঠা। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা ছিলেন তৎকালীন ন্যাপ’র জেলা পর্যায়ের একজন নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। যুদ্ধে শহীদ আমার দুই খালু চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে দুই খালাকে বৈধব্য বেশে সাদা শাড়ি পরতে দেখে আসছি সেই শৈশব থেকে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাবার সঙ্গে নানা বাড়িতে যখন বেড়াতে যেতাম, তখন দেখতাম পিতা হারানো আমার খালাতো ভাই-বোনরা কিভাবে লোভী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো আমার বাবার দিকে।
শৈশবের ওই সব স্মৃতিকাতরতার কারণেই আমি আজ ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিদারদের অন্যতম একজন। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার পর তাদের শনৈ শনৈ বিস্তৃতি আমার মতো অনেককেই শঙ্কিত করে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অনেক ব্যর্থতা এই শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
আর তাই বার বার স্বপ্ন দেখি, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির। ’৯০ দশকের প্রথম দিকে ড. কামালকে নিয়ে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। ড. কামাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতেন, অসাম্প্রদায়িক সমাজের কথা বলতেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলতেন। মনে করতাম, তাকে দিয়েই সম্ভব।
কিন্তু ব্যক্তিগত জেদাজেদি আদর্শিক রাজনীতিকেও অনেক সময় পেছনে ফেলে দেয়, একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আজ থেকে বছর দুয়েক আগে লন্ডনে ড. কামালের একটি মতবিনিময় সভায় গিয়ে প্রথম বুঝলাম। যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম তখন মাত্র শুরু হচ্ছে। জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী তখনও জেলের বাইরে।
বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানলাম, নিজামী বলেছেন ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার আগে ড. কামাল হোসেনের বিচার করতে হবে। নিজামীর ভাষায়, ’৭৩ এ সিমলা চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টি সুরাহা হয়ে যাওয়ার পর এখন আর এর বিচার করার সুযোগ নেই। এরপরও যদি তা করতে হয়, তাহলে ওই চুক্তিতে সম্মতি দেওয়ার অপরাধে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. কামালের বিচার করতে হবে আগে। লন্ডনের মতবিনিময় সভায় কামাল হোসেন নিজামীর এই মন্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, এমন আশা নিয়েই গিয়েছিলাম তার অনুষ্ঠানে।
কিন্তু দীর্ঘ বক্তৃতায় বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে সব বিষয়ে আলোচনা করলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুটি নিয়ে কামাল হোসেন কোনো মন্তব্যই করলেন না। বাধ্য হয়ে তার বক্তৃতা শেষে এই ইস্যুতে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তাও তিনি এড়িয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত বললাম, নিজের বিচার নয়, নিজামীতো আপনার বিচার চান, আপনি এখন কি বলবেন। এর উত্তরও এড়িয়ে গেলেন কামাল হোসেন।
অত্যন্ত শক্ড হলাম তাঁর আচরণে। বুঝতে পারলাম, শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে হাসিনা সরকারের নেওয়া জাতীয় দাবি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার উদ্যোগেও ড. কামাল হোসেনের মতো ‘জাতির বিবেক’ এর সমর্থন দিতে কষ্ট হচ্ছে। এ যেন ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’। এই ঘটনার পর থেকে আর দেখা হয়নি কামাল হোসেনের সঙ্গে। লন্ডন এলেও আর দৌঁড়ে যাই না তার কাছে।
শনিবার নীলফামারীতে দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অত্যন্ত কঠিন কাজ বলে করা কামাল হোসেনের মন্তব্য অনেকেই হয়তো নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করবেন। এই মন্তব্যের মাধ্যমে ড. কামাল কি এটি একটি কঠিন কাজ বলে তা বাদ দিয়ে দিতে বলছেন সরকারকে? এই যদি তার মন্তব্যের কারণ হয়, তাহলে দীর্ঘ চল্লিশ বছরেও কেন এই বিচার করতে পারেননি, একজন রাজনীতিক ও বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে এর দায় কি কামাল হোসেন নিজে এড়াতে পারবেন?
’৯০ দশকের প্রথম দিকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, সেই আন্দোলনেতো কামাল হোসেনও ছিলেন অগ্রভাগে। তখনও তো তিনি এই বিচার সম্ভব নয় বলে কোনো নিরাশার কথা জাতিকে শোনাননি। চল্লিশ বছর পর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ যখন বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে, ঠিক এমনি মুহূর্তে কেন কামাল হোসেনের মত ‘জাতির বিবেক’র এই নৈরাশ্যজনক মন্তব্য?
এটি কি শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগ বলেই? না শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বহি:প্রকাশ? আওয়ামী লীগও যে ধূয়া তুলসী পাতা এটি আমরা অনেকেই বলি না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে আওয়ামী লীগের কিছু সংখ্যক নেতার আন্তরিকতা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ আছে।
আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপিতো যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যুদ্ধাপরাধ বিচার বাধাগ্রস্থ করতে মিলিয়ন মিলিয়ন অর্থ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাঠে নেমেছে জামায়াত। ব্রিটিশ আইনজীবীদের মতো অনেক খ্যাতিমান আইনজীবীও আজ নিজেদের প্রফেশনের বাইরে গিয়ে এই অর্থের লোভে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জামায়াতের লবিস্ট হিসেবে কাজে নেমেছেন যুদ্ধাপরাধ বিচারকে বাধাগ্রস্থ করার লক্ষ্য নিয়ে।
এমনি অবস্থায় কামাল হোসেনের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান আইনজীবীর যেখানে প্রয়োজন এই বিচার প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করা, সেখানে তিনি তা না করে করছেন নৈরাশ্যজনক মন্তব্য। এতে লাভবান হচ্ছে কারা?
নীলফামারীতে করা ড. কামালের মন্তব্য জামায়াত সমর্থকরা বিভিন্ন মাধ্যমে যেভাবে ব্যাপক প্রচার করছে তাতেই বোঝা যাচ্ছে কামাল হোসেনের এই মন্তব্যের বেনিফিসিয়ারি কারা।
নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব বা ব্যক্তি বিদ্বেষ যদি কামাল হোসেনের এমন মন্তব্যের কারণ হয়, তাহলে একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এমন মন্তব্যের আগে তার চিন্তা করা উচিত ছিল যে, ড. কামাল শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি নন, দেশের সচেতন একটি অংশের কাছে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের মতো। সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে যে প্রতিষ্ঠানের রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস, যে প্রতিষ্ঠান মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও গণতন্ত্রের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরার সংগ্রাম শুরু করছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহামানবের হাত ধরে। আর এই মন্তব্য যদি রাজনীতিতে তার নতুন উপলব্দি হয়, তাহলে বলতে দ্বিধা নেই যে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শ্বশুর বাড়ি পাকিস্তানের কারাগারে থাকায় মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির সঠিক আত্মত্যাগ সম্পর্কে হয়তো তিনি দ্বিধাহীন ছিলেন না।
ড. কামাল হোসেন মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, এই যুদ্ধে তার কোনো পারিবারিক আত্মত্যাগ আছে কি না, আমার জানা নেই। তবে এটুকু বুঝতে পারি যে, ১৯৪৫ সালে সংগঠিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কোনো নাৎসির সাম্প্রতিক বিচার উদ্যোগে যিনি উৎফুল্ল হন, সেই কামাল হোসেন যখন নিজের দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে চল্লিশ বছর সময়কে অন্যতম বাঁধা হিসেবে চিহ্নিত করেন, তখন বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বাসের জায়গা হিসেবে তার অবস্থানকেই তিনি বিতর্কিত করেন।
জামায়াতের টাকার খেলার কারণে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও। ব্রিটেন এর অন্যতম কেন্দ্র। স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক মানের বিচার এমন সব প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে জামায়াতি টাকার বদৌলতে।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের একজন অতন্দ্র প্রহরী কামাল হোসেনের কাছে প্রশ্ন: স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ফৌজদারি, দেওয়ানিসহ যতো বিচার সম্পন্ন করেছে, ওই গুলো কি নিরপেক্ষ ছিল? যদি তাই হয়, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আজ কেন নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মানের এতো সব প্রশ্ন? আগের বিচার কার্যক্রম বিষয়ে বিচার বিভাগের মান ও নিরপেক্ষতা যেহেতু আন্তর্জাতিক অঙ্গণে কোনো বিতর্ক তোলেনি, সেহেতু ধরে নেওয়া যায়, বাংলাদেশের বিচার সিস্টেম আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ক্ষেত্রে কেন আজ নতুন করে এতো সব পশ্ন?
ড. হোসেন, ব্রিটেনের মতো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের সময় মানুষের পছন্দ থাকে, মূল দুটো বা তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতি। এক দল ব্যর্থ হলে, পরবর্তী নির্বাচনে অন্য দলকে পছন্দ করেন মানুষ। বাংলাদেশে আমার মতো অনেকেরই চাহিদা তো এমনই ছিল। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুটো প্রধান দল রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেদের সফলতা-ব্যর্থতার কারণেই ঘুরে ফিরে ক্ষমতায় আসবে, ক্ষমতাচ্যূত হবে, সাধারণ মানুষের পছন্দের একটি সুযোগ থাকবে, এতটুকুইতো আমাদের চাওয়া। কিন্তু আমার মতো অনেককেই নির্বাচনের সময় বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিতে হয়। আর আওয়ামী লীগও এই শ্রেণীর ভোটারদের এই দুর্বলতার সুযোগ নেয়।
আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপি’র দিকে মুখ ফেরাতে চাইলেই আমরা দেখি, ’৭১ এর ঘাতকরা বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী, আর তখনই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বৈধব্য বেশে সাদা শাড়ি পরিহিত আমার দুই খালার চেহারা। আওয়ামী লীগের ওপর বিরক্ত হয়ে যখন বিএনপি’র দিকে মুখ ফেরাতে চাই, তখনই দেখি, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম রাখতে চায় বিএনপি, দেখি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন বিএনপি নেত্রী!
এমনি অবস্থায় ’৭১ এর স্বজন হারানোর শোক নিয়ে আওয়ামী লীগের শত ব্যর্থতা থাকলেও বিএনপিমুখী হই কিভাবে আপনিই বলুন? আর অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির হর্তাকর্তা আপনারা আওয়ামী লীগের এমন একটি বিকল্পও এতো দিনে তৈরি করতে পারেননি, যার ওপর আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায় ক্ষুব্দ জনগোষ্ঠী নির্ভর করতে পারে। ’৯০ দশকে বিকল্প শক্তির লোভ যখন দেখালেন আপনি, আমরা অনেকেই তো আপনাকে সমর্থন দিয়েছিলাম। কি লাভ হলো। তখনকার শক্তিশালী বাম দল, শোষিত মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে যাদের বিবেচনা করা হতো, সেই কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ’র মতো সংগঠন ভেঙ্গে আপনি গণফোরাম করলেন। আবুল মাল আব্দুল মুহিত, নুরুল ইসলাম নাহিদ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, প্রয়াত সাইফুদ্দিন মানিক, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামসহ অনেক প্রতিথযশা ব্যক্তিই তো আপনাকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
কিন্তু বিনিময়ে আপনি কি দিতে পেরেছেন আমাদের একটি বিকল্প শক্তি? এই দিতে না পারার অপরাধ কি দেশের মানুষের? ড. হোসেন, আপনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর। আপনার অনেক পরামর্শই তিনি বিবেচনায় নিতেন বলে শুনেছি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের শূন্যস্থান পূরণের জন্যে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ একটি বিকল্প শক্তি তৈরিতে পেছন থেকে সহযোগিতার বিষয়ে তাকে যদি পরামর্শ দিতেন, তাহলে আজ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা এই পর্যায়ে আসতো না, বিএনপি’র মতো একটি সাম্প্রদায়িকতা ঘেষা দলেরও জন্ম হতো না। এই যে ব্যর্থতা আপনার মতো রাজনীতিকদের, এর দায়ও কি আমাদের সাধারণ জনগণের?
ব্যক্তি বিদ্বেষের কারণে মৌলিক সব উপলব্দি পেছনে রেখে আজ আপনি নতুন উপলব্দির কথা শোনাচ্ছেন জাতিকে। আপনার নতুন এই উপলব্ধিকে পুঁজি করে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত যে আজ বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে, এটি কি আপনি বুঝতে পারছেন? এই বিষয়টিও আবার আপনাকে নতুন করে উপলব্দি করার অনুরোধ করছি ড. কামাল হোসেন।
ড. হোসেন, বাঙালির বিশ্বাসের জায়গার বড় অভাব। সামান্যতম যাও আছে তা থেকে জাতিকে বঞ্চিত করবেন না প্লিজ। যুদ্ধাপরাধ বিচার ইস্যুতে আপনার মতো আইনজীবীদের সম্পৃক্ত করতে না পারা হাসিনা সরকারের একটি চরম ব্যর্থতা, এটি আমি স্বীকার করি। কিন্তু তাই বলে এই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে করা আপনার কোনো মন্তব্য যুদ্ধাপরাধীদের পালে আরও হাওয়া দেবে, এটি তো আমরা মেনে নিতে পারি না।
জাতীয় কর্তব্য হিসেবেই আপনাকে এই বিচার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ, আপনি যে ‘জাতির বিবেক’, বঙ্গবন্ধুর মতো মহামানবের পথ চলার সঙ্গী ছিলেন আপনি। রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে আপনার গঠনমূলক সমালোচনার আমরাও সমর্থক হতে চাই। কিন্তু প্লিজ, এমন কোনো ভূমিকা নেবেন না, যে ভূমিকার ফলে ’৭১ এর ঘাতককূল শিরোমণি গোলাম আযম যেন আবার ‘অলিকূল শিরোমণি’র খেতাব নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
জনাব কামাল হোসেন, মহাজোটে থেকেও সরকারের কিছু কিছু ব্যর্থতার কারনে আওয়ামী লীগের ওপর খুব একটা খুশি নন, মেনন, ইনুর মতো নেতারা। কিন্তু তারাও তো হাল ছেড়ে দেননি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়েই তারা আছেন মাঠে। মহাজোটের বাইরে থেকেও কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে মাঠ গরম রাখে।
আর আপনি ব্যক্তি বিদ্বেষের কারণে অভিমান করে জাতিকে নতুন নতুন উপলদ্ধির কথা শোনান, যে উপলদ্ধিতে লাভবান হয় যুদ্ধাপরাধীরা, এটি কি ঠিক?
বিষয়টি একটু ভেবে দেখুন, প্লিজ!
বাংলাদেশ সময়: ২১১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১২
0 comments:
Post a Comment