সৈয়দ আশরাফের বৈঠকে হঠাৎ এলার্ম
টাওয়ার হ্যামলেটস মেয়র-স্পিকার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
লন্ডন: তৃতীয় বাংলা হিসেবে খ্যাত লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস বারার স্পিকার ও প্রথম নাগরিক কাউন্সিলর রাজিব আহমেদের সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সৌজন্য বৈঠকে রহস্যজনকভাবে ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠা এবং তড়িঘড়ি আমন্ত্রিত অতিথিসহ সবার বৈঠক স্থল ত্যাগ করা নিয়ে বাঙালি কমিউনিটিতে চলছে তোলপাড়।
স্পিকার রাজিব আহমদসহ টাওয়ার হ্যামলেটস লেবার গ্রুপ নেতারা এই এলার্ম বেজে ওঠাকে রহস্যজনক অভিহিত করে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়রের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে সিসি টিভি ফুটেজ পরীক্ষাসহ ঘটনাটির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছেন।
পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকে ছোট ছোট ইস্যু তৈরির অপচেষ্টা মন্তব্য করে মেয়র লুৎফুর রহমান বলেছেন ‘বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার ছড়িয়ে আমাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।’
বিষয়টি নিয়ে শুধু বাংলাদেশি কমিউনিটির ভেতরেই তোলপাড় হচ্ছে না, মূলধারার স্থানীয় পত্রিকা, এমপি, রাজনীতিকদের মধ্যেও চলছে তোলপাড়, উত্তজনা।
পূর্ব লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ইস্ট লন্ডন অ্যাডভারটাইজার Bangladesh minister barred from Olympic host Tower Hamlets council chamber শিরোনামে করা তাদের নিউজে সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী, বারার স্পিকার এবং লেবার ও কনজারভেটিভ দলের গ্রুপ লিডারের মন্তব্য উল্লেখ্য করে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ তদন্তের ওপর জোড় দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে টাওয়ার হ্যামলেটস টাউন হলের লেবার গ্রুপ অফিসে সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে স্পিকারের ওই সৌজন্য বৈঠক শুরু হলেও মাত্র ২০ মিনিটের ব্যবধানে হঠাৎ করে ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠায় তড়িঘড়ি করে পুরো টাউন হল খালি করে সবাইকে রাস্তায় নেমে আসতে হয়। শেষ পর্যন্ত বৈঠকের শেষ অংশটি রাস্তায় দাঁড়িয়েই সম্পন্ন করতে হয় বাংলাদেশের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও টাওয়ার হ্যামলেটস বারার প্রথম নাগরিক স্পিকারকে।
কর্ম চঞ্চল অফিস সময়ে ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠা ব্রিটেনে একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও সৈয়দ আশরাফ-স্পিকার রাজিব বৈঠকে এলার্ম বেজে ওঠা নিয়ে এতো তোলপাড়েরও রয়েছে একটি বিশেষ কারণ।
টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়রের আমন্ত্রণে সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠানটি বুধবারই হওয়ার কথা ছিল কাউন্সিল চেম্বারে। কিন্তু বুধবারের নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা আগে হঠাৎ করেই কাউন্সিল চেম্বার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমানের পক্ষ থেকে। আর এ থেকেই শুরু হয়, বিতর্ক, সন্দেহ, গুজব ও গুঞ্জন।
বাঙালি অধ্যুষিত বারার কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী হওয়ার কারণেই সৈয়দ আশরাফকে কাউন্সিল হলে ঢুকতে দিতে চান না মেয়র। আর এ কারণেই কাউন্সিল চেম্বার ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছেন না তিনি।
এই গুঞ্জনের উত্তরে মেয়র বলেন, কাউন্সিলের কোনো অফিসিয়াল সভা না থাকায় পলিসিগত কারণেই তাঁরা চেম্বার ব্যবহারের অনুমতি দিতে ছিলেন অপারগ।
বুধবার কাউন্সিল চেম্বার ব্যবহারের অনুমতি না পাওয়ায় স্পিকারের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার টাউন হলের লেবার গ্রুপের অফিসে আয়োজন করা হয় নির্ধারিত দুই নেতার সৌজন্য বৈঠক। কিন্তু মাত্র ২০ মিনিট অতিক্রান্ত হতেই যখন ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠে তখন কাউন্সিল চেম্বার ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞার কথা স্মরণে এনে স্বাভাবিক কারণেই এই এলার্ম বাজার পেছনে রহস্য রয়েছে বলে সবাই সন্দেহ করেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্যতম অতিথি ব্রিটেনের সাবেক মন্ত্রী ও লেবার দলীয় এমপি জিম ফিটজ পেট্রিক ইস্ট লন্ডন অ্যাডভারটাইজারের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘‘এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যদি বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভিজিটের সময় ইচ্ছে করে কেউ এই সময় ফায়ার এলার্ম অন করে থাকেন।’’
সাবেক মন্ত্রী জিম ফিটজ পেট্রিক কাউন্সিল চেম্বারের ব্যবহারে মেয়রের আগের নিষেধাজ্ঞার নিন্দা করে বলেন, মেয়রের এই আচরণে একজন আন্তর্জাতিক অতিথি নিশ্চয় অপমাণিত বোধ করতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘‘এটি খুবই দুঃখজনক যে, অলিম্পিক উপলক্ষে আমরা যখন অন্যান্য দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছি, ঠিক তখনই আয়োজক বারা টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাহী মেয়র একজন বিদেশি সম্মানিত অতিথিকে টাউন হল পরিদর্শনের সব সুযোগ প্রত্যাহার করে নিলেন।’’
তিনি আরও বলেন, মেয়র লুৎফুর রহমানের জন্যে এটি একটি বড় ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত, যা একজন বিদেশি অতিথি হয়তো নিজের জন্যে অপমানজনক বলে মনে করলেন।
জিম উল্লেখ করেন, স্পিকার-সৈয়দ আশরাফের বৈঠকের সময় কাউন্সিল চেম্বার খালি অবস্থায় তালাবদ্ধই ছিল, অথচ স্পিকারকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হলো না।
টাওয়ার হ্যামলেটস লেবার গ্রুপের ডেপুটি লিডার কাউন্সিলর মতিন উজ জামান সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করে বলেছেন, ‘‘আমরা চাই প্রতিটি সিসিটিভি ফুটেজ পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা করে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর অনুষ্ঠানের সময় হঠাৎ করে ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠার পেছনে কারো ইন্ধন ছিল কী না। যদি থেকে থাকে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।’’
তিনি বলেন, কাউন্সিল চেম্বার পরিদর্শনে বাংলাদেশের মন্ত্রীকে যদি বাধা দেওয়া না হতো, তাহলে তাঁকে বুঝানো যেতো ব্রিটেনের স্থানীয় সরকার কিভাবে পরিচালিত হয়।
টোরি গ্রুপ লিডার পিটার গোল্ড ইস্ট লন্ডন অ্যাডভারটাইজারকে বলেছেন, ‘‘কাউন্সিল চেম্বার তালাবদ্ধ করে রাখা আমাদের জন্যে বিব্রতকর। এটি টাওয়ার হ্যামলেটসকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।’’
টাওয়ার হ্যামলেটসের স্পিকার কাউন্সিলার রাজিব আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক, ব্রিটেনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও দেশে ফেলে আসা ব্রিটেন প্রবাসীদের সম্পত্তি রক্ষা, দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রভাবশালী এ মন্ত্রীর সঙ্গে।
কিন্তু কাউন্সিল চেম্বার তালাবদ্ধ করায় এবং সর্বশেষ রহস্যজনক ফায়ার এলার্মের কারণে সেই সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। আলোচনার সুযোগ হলে প্রবাসীদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষ গুম ইত্যাদি বিষয়গুলো মন্ত্রীর নজরে আনতে পারতাম। কিন্ত মেয়র সে সুযোগ দিলেন না।’’
এদিকে, সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে স্পিকারের বৈঠকে কাউন্সিল চেম্বার ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়ার বিতর্কটি বুধবার থেকে শুরু হলেও বৃহস্পতিবার তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এর পরই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান সংবাদ পত্রে এক বিবৃতিতে এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশি একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে টাউন হলে বৃহস্পতিবার যে সভা আহবান করা হয়েছিল, সেটি কাউন্সিলের কোনো অফিসিয়াল অনুষ্ঠান ছিল না। লেবার গ্রুপের রুমে আয়োজিত ওই মিটিংকে কেন্দ্র করে আমার ব্যাপারে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ওই সভা চলাকালীন আমি নিজে টাউন হলে ছিলাম না, অন্যত্র জরুরি সভায় ছিলাম।
তিনি বলেন, প্রথমে কাউন্সিল চেম্বারে ওই সভা আহবান করা হলে পলিসি অনুযায়ী চেম্বার বরাদ্দ দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। পরে সেই সভা টাউন হলে লেবার গ্রুপের অফিসে যথাযথভাবে আয়োজন করা হয়। কিন্তু বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বলা হচ্ছে মেয়র সভা বাতিল করে দিয়েছেন। অথচ আমার অফিসে এই কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল এমপি সৌজন্য বৈঠক করে গেছেন।
মেয়র অভিযোগ করে বলেন, লেবার গ্রুপের অফিসে সভা শুরু হলে স্থানাভাবে কিছু মানুষ আটকা পড়েন। কিন্তু ফ্যাসিলিটিজ কর্মকর্তারা যতটুকু সম্ভব প্রায় সবাইকে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দেন। কিন্তু এ সময় কিছু ব্যক্তি ফ্যাসিলিটি স্টাফের সঙ্গে অকথ্য ভাষায় কথা বলেন, উচ্চবাচ্য করেন, যা কারো কাম্য নয়’।
ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠা ব্রিটেনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা মন্তব্য করে তাঁর দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলার প্রতি ইঙ্গিত করে নির্বাহী মেয়র এটি নিয়ে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্যে সবার প্রতি আহবান জানান।
তিনি বলেন, ‘বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার ছড়িয়ে আমাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।’
এদিকে, শুক্রবার লন্ডন সময় দুপুরে টাওয়ার হ্যামলেটসের স্পিকার কাউন্সিলর রাজিব আহমদ এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। টাওয়ার হ্যামলেটস লেবার গ্রুপও বিষয়টি তাদের জন্যে খুবই অসম্মানের হিসেবে গণ্য করে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে কাউন্সিলের আগামী পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে এ বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফকে কাউন্সিল চেম্বারে ঢুকতে না দেওয়ার এই ঘটনাটি ব্রিটিশ রাজনীতির মূলধারায়ও ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিতে পারে বলে রাজনীতি বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।
তারা প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির নোংরা দিকটি আজ ব্রিটিশ রাজনীতিতে নিয়ে এসে কমিউনিটিকে যে বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি করা হয়েছে এর দায় কার? কেউ কেউ মেয়রের আমন্ত্রণে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের সমালোচক আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি আব্দুল জলিলের টাউন হল পরিদর্শনের কথা স্মরণ করে প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে সৈয়দ আশরাফের বিষয়ে কাউন্সিল হল ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে কি এমন পলিসিগত বাধা?
উল্লেখ্য, স্পিকার রাজিব আহমেদের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বৈঠকের সময় সিলেট-২ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময় : ০৯২৫ ঘণ্টা, ১০ আগস্ট, ২০১২
স্পিকার রাজিব আহমদসহ টাওয়ার হ্যামলেটস লেবার গ্রুপ নেতারা এই এলার্ম বেজে ওঠাকে রহস্যজনক অভিহিত করে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়রের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে সিসি টিভি ফুটেজ পরীক্ষাসহ ঘটনাটির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছেন।
পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকে ছোট ছোট ইস্যু তৈরির অপচেষ্টা মন্তব্য করে মেয়র লুৎফুর রহমান বলেছেন ‘বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার ছড়িয়ে আমাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।’
বিষয়টি নিয়ে শুধু বাংলাদেশি কমিউনিটির ভেতরেই তোলপাড় হচ্ছে না, মূলধারার স্থানীয় পত্রিকা, এমপি, রাজনীতিকদের মধ্যেও চলছে তোলপাড়, উত্তজনা।
পূর্ব লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ইস্ট লন্ডন অ্যাডভারটাইজার Bangladesh minister barred from Olympic host Tower Hamlets council chamber শিরোনামে করা তাদের নিউজে সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী, বারার স্পিকার এবং লেবার ও কনজারভেটিভ দলের গ্রুপ লিডারের মন্তব্য উল্লেখ্য করে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ তদন্তের ওপর জোড় দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে টাওয়ার হ্যামলেটস টাউন হলের লেবার গ্রুপ অফিসে সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে স্পিকারের ওই সৌজন্য বৈঠক শুরু হলেও মাত্র ২০ মিনিটের ব্যবধানে হঠাৎ করে ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠায় তড়িঘড়ি করে পুরো টাউন হল খালি করে সবাইকে রাস্তায় নেমে আসতে হয়। শেষ পর্যন্ত বৈঠকের শেষ অংশটি রাস্তায় দাঁড়িয়েই সম্পন্ন করতে হয় বাংলাদেশের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও টাওয়ার হ্যামলেটস বারার প্রথম নাগরিক স্পিকারকে।
কর্ম চঞ্চল অফিস সময়ে ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠা ব্রিটেনে একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও সৈয়দ আশরাফ-স্পিকার রাজিব বৈঠকে এলার্ম বেজে ওঠা নিয়ে এতো তোলপাড়েরও রয়েছে একটি বিশেষ কারণ।
টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়রের আমন্ত্রণে সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠানটি বুধবারই হওয়ার কথা ছিল কাউন্সিল চেম্বারে। কিন্তু বুধবারের নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা আগে হঠাৎ করেই কাউন্সিল চেম্বার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমানের পক্ষ থেকে। আর এ থেকেই শুরু হয়, বিতর্ক, সন্দেহ, গুজব ও গুঞ্জন।
বাঙালি অধ্যুষিত বারার কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী হওয়ার কারণেই সৈয়দ আশরাফকে কাউন্সিল হলে ঢুকতে দিতে চান না মেয়র। আর এ কারণেই কাউন্সিল চেম্বার ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছেন না তিনি।
এই গুঞ্জনের উত্তরে মেয়র বলেন, কাউন্সিলের কোনো অফিসিয়াল সভা না থাকায় পলিসিগত কারণেই তাঁরা চেম্বার ব্যবহারের অনুমতি দিতে ছিলেন অপারগ।
বুধবার কাউন্সিল চেম্বার ব্যবহারের অনুমতি না পাওয়ায় স্পিকারের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার টাউন হলের লেবার গ্রুপের অফিসে আয়োজন করা হয় নির্ধারিত দুই নেতার সৌজন্য বৈঠক। কিন্তু মাত্র ২০ মিনিট অতিক্রান্ত হতেই যখন ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠে তখন কাউন্সিল চেম্বার ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞার কথা স্মরণে এনে স্বাভাবিক কারণেই এই এলার্ম বাজার পেছনে রহস্য রয়েছে বলে সবাই সন্দেহ করেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্যতম অতিথি ব্রিটেনের সাবেক মন্ত্রী ও লেবার দলীয় এমপি জিম ফিটজ পেট্রিক ইস্ট লন্ডন অ্যাডভারটাইজারের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘‘এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যদি বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভিজিটের সময় ইচ্ছে করে কেউ এই সময় ফায়ার এলার্ম অন করে থাকেন।’’
সাবেক মন্ত্রী জিম ফিটজ পেট্রিক কাউন্সিল চেম্বারের ব্যবহারে মেয়রের আগের নিষেধাজ্ঞার নিন্দা করে বলেন, মেয়রের এই আচরণে একজন আন্তর্জাতিক অতিথি নিশ্চয় অপমাণিত বোধ করতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘‘এটি খুবই দুঃখজনক যে, অলিম্পিক উপলক্ষে আমরা যখন অন্যান্য দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছি, ঠিক তখনই আয়োজক বারা টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাহী মেয়র একজন বিদেশি সম্মানিত অতিথিকে টাউন হল পরিদর্শনের সব সুযোগ প্রত্যাহার করে নিলেন।’’
তিনি আরও বলেন, মেয়র লুৎফুর রহমানের জন্যে এটি একটি বড় ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত, যা একজন বিদেশি অতিথি হয়তো নিজের জন্যে অপমানজনক বলে মনে করলেন।
জিম উল্লেখ করেন, স্পিকার-সৈয়দ আশরাফের বৈঠকের সময় কাউন্সিল চেম্বার খালি অবস্থায় তালাবদ্ধই ছিল, অথচ স্পিকারকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হলো না।
টাওয়ার হ্যামলেটস লেবার গ্রুপের ডেপুটি লিডার কাউন্সিলর মতিন উজ জামান সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করে বলেছেন, ‘‘আমরা চাই প্রতিটি সিসিটিভি ফুটেজ পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা করে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর অনুষ্ঠানের সময় হঠাৎ করে ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠার পেছনে কারো ইন্ধন ছিল কী না। যদি থেকে থাকে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।’’
তিনি বলেন, কাউন্সিল চেম্বার পরিদর্শনে বাংলাদেশের মন্ত্রীকে যদি বাধা দেওয়া না হতো, তাহলে তাঁকে বুঝানো যেতো ব্রিটেনের স্থানীয় সরকার কিভাবে পরিচালিত হয়।
টোরি গ্রুপ লিডার পিটার গোল্ড ইস্ট লন্ডন অ্যাডভারটাইজারকে বলেছেন, ‘‘কাউন্সিল চেম্বার তালাবদ্ধ করে রাখা আমাদের জন্যে বিব্রতকর। এটি টাওয়ার হ্যামলেটসকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।’’
টাওয়ার হ্যামলেটসের স্পিকার কাউন্সিলার রাজিব আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক, ব্রিটেনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও দেশে ফেলে আসা ব্রিটেন প্রবাসীদের সম্পত্তি রক্ষা, দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রভাবশালী এ মন্ত্রীর সঙ্গে।
কিন্তু কাউন্সিল চেম্বার তালাবদ্ধ করায় এবং সর্বশেষ রহস্যজনক ফায়ার এলার্মের কারণে সেই সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। আলোচনার সুযোগ হলে প্রবাসীদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষ গুম ইত্যাদি বিষয়গুলো মন্ত্রীর নজরে আনতে পারতাম। কিন্ত মেয়র সে সুযোগ দিলেন না।’’
এদিকে, সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে স্পিকারের বৈঠকে কাউন্সিল চেম্বার ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়ার বিতর্কটি বুধবার থেকে শুরু হলেও বৃহস্পতিবার তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এর পরই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান সংবাদ পত্রে এক বিবৃতিতে এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশি একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে টাউন হলে বৃহস্পতিবার যে সভা আহবান করা হয়েছিল, সেটি কাউন্সিলের কোনো অফিসিয়াল অনুষ্ঠান ছিল না। লেবার গ্রুপের রুমে আয়োজিত ওই মিটিংকে কেন্দ্র করে আমার ব্যাপারে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ওই সভা চলাকালীন আমি নিজে টাউন হলে ছিলাম না, অন্যত্র জরুরি সভায় ছিলাম।
তিনি বলেন, প্রথমে কাউন্সিল চেম্বারে ওই সভা আহবান করা হলে পলিসি অনুযায়ী চেম্বার বরাদ্দ দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। পরে সেই সভা টাউন হলে লেবার গ্রুপের অফিসে যথাযথভাবে আয়োজন করা হয়। কিন্তু বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বলা হচ্ছে মেয়র সভা বাতিল করে দিয়েছেন। অথচ আমার অফিসে এই কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল এমপি সৌজন্য বৈঠক করে গেছেন।
মেয়র অভিযোগ করে বলেন, লেবার গ্রুপের অফিসে সভা শুরু হলে স্থানাভাবে কিছু মানুষ আটকা পড়েন। কিন্তু ফ্যাসিলিটিজ কর্মকর্তারা যতটুকু সম্ভব প্রায় সবাইকে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দেন। কিন্তু এ সময় কিছু ব্যক্তি ফ্যাসিলিটি স্টাফের সঙ্গে অকথ্য ভাষায় কথা বলেন, উচ্চবাচ্য করেন, যা কারো কাম্য নয়’।
ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠা ব্রিটেনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা মন্তব্য করে তাঁর দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলার প্রতি ইঙ্গিত করে নির্বাহী মেয়র এটি নিয়ে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্যে সবার প্রতি আহবান জানান।
তিনি বলেন, ‘বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার ছড়িয়ে আমাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।’
এদিকে, শুক্রবার লন্ডন সময় দুপুরে টাওয়ার হ্যামলেটসের স্পিকার কাউন্সিলর রাজিব আহমদ এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। টাওয়ার হ্যামলেটস লেবার গ্রুপও বিষয়টি তাদের জন্যে খুবই অসম্মানের হিসেবে গণ্য করে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে কাউন্সিলের আগামী পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে এ বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফকে কাউন্সিল চেম্বারে ঢুকতে না দেওয়ার এই ঘটনাটি ব্রিটিশ রাজনীতির মূলধারায়ও ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিতে পারে বলে রাজনীতি বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।
তারা প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির নোংরা দিকটি আজ ব্রিটিশ রাজনীতিতে নিয়ে এসে কমিউনিটিকে যে বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি করা হয়েছে এর দায় কার? কেউ কেউ মেয়রের আমন্ত্রণে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের সমালোচক আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি আব্দুল জলিলের টাউন হল পরিদর্শনের কথা স্মরণ করে প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে সৈয়দ আশরাফের বিষয়ে কাউন্সিল হল ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে কি এমন পলিসিগত বাধা?
উল্লেখ্য, স্পিকার রাজিব আহমেদের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বৈঠকের সময় সিলেট-২ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময় : ০৯২৫ ঘণ্টা, ১০ আগস্ট, ২০১২
0 comments:
Post a Comment