Syed Anas Pasha

Syed Anas Pasha


‘ব্রিটেন বাংলাদেশকে আফগানিস্তান দেখতে চায় না’


সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন কসেপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বক্তব্য রাখছেন বা থেকে- জিন লেমবার্ট এমইপি, এমিলি থর্নবেরী এমপি, ড. চার্লস টেনক এমইপি, লিয়ন সিলভার ও গীতা সায়গল
আলতাব আলী পার্ক, লন্ডন থেকে: বাংলাদেশে উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর সাম্প্রতিক তাণ্ডবে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্রিটিশ লেবার দলীয় এমপি ও ছায়া অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এমিলি থর্নবেরী বলেছেন, “দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ আরেক আফগানিস্তান হোক, এটি আমরা দেখতে চাইনা। বাংলাদেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনা দেশটিকে আফগানিস্তান হওয়া থেকে রক্ষা করবে, এটি আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।”

রোববার বিকেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ইন্টারন্যাশনেল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) সাপোর্ট ফোরামের উদ্যোগে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে এক সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করতে এসে এমিলি থর্নবেরী এমপি এসব মন্তব্য করেন।

ব্রিটেন প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধের প্রবীণ সংগঠক সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে এবং আইসিটি সাপোর্ট ফোরাম নেতা সৈয়দ ফারুক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আনসার আহমেদ উল্লার পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে সংহতি বক্তব্য রাখেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের লন্ডন রিজিওনের কনজারভেটিভ দলীয় এমইপি ড. চার্লস টেনক, ইউরোপিয় পার্লামেন্টের সাউথ এশিয়ান ডেলিগেশনের চেয়ার জিন লিমবার্ট এমইপি, সেন্টার ফর সেক্যুলার স্পেইসের চেয়ারপার্সন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ইয়াসমীন রেহমান, সেন্টার ফর সেক্যুলার স্পেইসের ডাইরেক্টর ব্রিটিশ সাংবাদিক গীতা সায়গল, ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির লন্ডন রিজিয়নের সেক্রেটারি কমরেড স্টিভ জনসন, ইজলিংটনের কাউন্সিলার জেমস মাররে এবং ইস্ট লন্ডন সেন্ট্রাল সিনাগগের লিয়ন সিলভারসহ আইসিটি সাপোর্ট ফোরামের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।

ব্রিটিশ ছায়া অ্যাটর্নি জেনারেল জেনারেল ব্যারিস্টার এমিলি থর্নবেরী এমপি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে বলেন, “বাংলাদেশের জন্মলগ্নে সংগঠিত মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজনের বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। দেশটির জন্মের দীর্ঘ চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর পর হলেও এ বিচারের উদ্যোগ নি:সন্দেহে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”

ব্রিটিশ এমপি থর্নবেরী বলেন, “রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবে, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু এই মতপার্থক্যের বহি:প্রকাশ কোনো মতেই সহিংসতা হতে পারে না।”

লেবার দলীয় এই এমপি আরও বলেন, “যুদ্ধাপরাধ বিচারের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যেখানে প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য, সেখানে এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে চলছে সহিংসতা। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

যথাযথ বিচারের মাধ্যমে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দাবি করে ব্রিটিশ এমপি থর্নবেরী আরও বলেন, “নীতিগত ভাবে ব্রিটেন মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী হলেও অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তিই বাংলাদেশের জনগণের হৃদয় থেকে একাত্তরের ক্ষত মুছাতে পারে বলে আমি মনে করি।”

সমাবেশে সংহতি বক্তব্য দিতে গিয়ে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে কনজারভেটিভ দলীয় এমইপি ড. চার্লস টেনক বলেন, “অপরাধের শাস্তি বিশ্ব সভ্যতায় একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের জনগণ এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে থাকতে পারে না।”

“একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের উদ্যোগ আমরা সব সময়ই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছি”- এমন মন্তব্য করে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির লন্ডন রিজিয়নের এই এমইপি বলেন, “একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে একটি নজির হতে পারে।”

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাউথ এশিয়ান ডেলিগেশনের চেয়ার জিন লিমবার্ট এমইপি তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, “মৃত্যুদণ্ড প্রথার বিরোধী হলেও আমরা জানি, বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ায় এ প্রথাটি রয়েছে। এ ইস্যুতে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের অবস্থান আমাদের অবস্থানের মতো নয়।”

তিনি বলেন, “আমরা বার বার বলে আসছি যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্যে একটি কার্যকর ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে সংঘটিত ইতিহাসের জঘণ্যতম গণহত্যার বিচার দেশটিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যেও অত্যন্ত জরুরি। আমরা এ বিচারের উদ্যোগকে সমর্থনের কথা বার বার বলে আসছি। এ বিচারকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের নামে সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ সব ধরনের সহিংসতারও বিরোধিতা করি আমরা।”

সেন্টার ফর সেক্যুলার স্পেইসের ডাইরেক্টর, বিশিষ্ট ব্রিটিশ সাংবাদিক গীতা সায়গল বলেন, “ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল জামায়াতই মূলত একাত্তরের গণহত্যার মূল পরিকল্পক ও সংগঠক। এ গণহত্যার বিচার না হওয়ার জন্যেই এ উগ্র ধর্মান্ধ দলটি বাংলাদেশের পুরো সেক্যুলার চরিত্রই আজ পাল্টে দেয়ার অপচেষ্টারত রয়েছে।”

জামায়াতের ইস্ট লন্ডন ভিত্তিক শক্ত অবস্থানের ব্যাখ্যা দিয়ে ব্রিটিশ সাংবাদিক গীতা বলেন,  “একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল নায়ক ব্রিটেনে আশ্রয় নিয়ে ধীরে ধীরে এখানেও জামায়াত নামক উগ্র এই দলটিকে বিস্তৃত করেছেন, যা মাল্টিকালচারেল ব্রিটেনের জন্যেও আজ অনেকটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

ব্রিটেনে আশ্রয় নেওয়া বুদ্ধিজীবী হত্যার ওই নায়কসহ সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে গীতা সায়গল বলেন, “নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী হলেও এই ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই আমরাও।”

তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সদ্য অভিযুক্ত ব্রিটেন প্রবাসী বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ককে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরের আহবান জানান ব্রিটিশ সরকারের প্রতি।

ইস্ট লন্ডন সেন্ট্রাল সিনাগগের লিয়ন সিলভার বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সমাবেশে বলেন, “একাত্তরের নরঘাতকরা দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর বিচার থেকে রেহাই পাওয়ার কারণেই বিগত দিনে বার বার বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিরযাতনের ঘটনা ঘটেছে। এরাই আজ একাত্তরের অপকর্ম থেকে তাদের নেতাদের বাঁচাতে আন্দোলনের নামে সহিংসতা চালাচ্ছে বাংলাদেশে।”

এই অপশক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের চলমান আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ার জন্যে ব্রিটিশ জনগণের প্রতি আহবান জানান লিয়ন সিলভার।

ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির লন্ডন রিজিয়নের সেক্রেটারি কমরেড স্টিভ জনসন তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, “সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুগে যুগে তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্যেই সাম্প্রদায়িক উগ্র সংগঠনগুলোকে মদদ দিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের ধর্মান্ধ ওই সব দলগুলোও এর বাইরে নয়।”

একাত্তরের গণহত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে স্টিভ বলেন, “বাংলাদেশের জনগণের চলমান এ আন্দোলনে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন অব্যাহত থাকবে।”

সমাবেশ শেষে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও ব্রিটেনে বসবাসরত বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান অভিযুক্ত আসামিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর দাবিতে এক বিরাট গণমিছিল বাংলাটাউন এলাকা প্রদক্ষিণ করে। সমাবেশ ও গণমিছিল চলাকালে পুলিশ ব্যাপক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে পুরো এলাকা জুড়ে।

সমাবেশ শুরুর আগে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীরা জাতীয় সঙ্গীত ও গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৩

0 comments:

Post a Comment

Popular Posts