বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, লন্ডন থেকে: জামায়াত বা হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে না বিএনপি। সুতরাং রাজনীতিতে জামায়াত-হেফাজত কী ভূমিকা রাখলো সেটা আমাদের দেখবার বিষয় নয়।
লন্ডনে ‘বাংলাদেশ: ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ শীর্ষক সেমিনারে মৌলবাদী সহিংস রাজনীতি নিয়ে আলোচনাকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুলের আগে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে জামায়াত-বিএনপির অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে আইনী লড়াইয়ে সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অংশ নেবেন, আসামিদের নির্দোষ প্রমাণ করতে সব ‘তথ্য-উপাত্ত’ নিয়ে প্রতিটি কার্যদিনে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হবেন, অথচ রায় হলেই তা মানি না বলে রাস্তায় সহিংসতায় নামবেন এটা তো হয় না।’
তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এই প্রাণবন্ত বিতর্কের প্রশংসা করে বিরোধী দলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এভাবে একসঙ্গে বসে আমাদের সমস্যার কথা দেশে কেন আমরা আলোচনা করতে পারি না।’
তিনি অবশ্য বিএনপির সাম্প্রতিক পার্লামেন্টে যোগদানের ঘটনাকে আশার আলো উল্লেখ করে ‘এই প্র্যাকটিস অব্যাহত রাখতে পারলে সব সমস্যারই সমাধান সম্ভব’ বলে মন্তব্য করেন।
ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পার্লামেন্টের হাউস অব লর্ডসের কমিটি রুম জি-তে বুধবার স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দুটো উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান লর্ড এরিক এভিবারির সভাপতিত্বে এবং অলপার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের চেয়ার কনজারভেটিভ দলীয় এমপি আন মেইনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে ব্রিটিশ রাজনীতিকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন লিবারেল ডেমোক্রেট দলীয় লর্ড সদস্য কার্লাইল, লেবার দলীয় লর্ড সদস্য ব্যারোনেস পলা উদ্দিন, লেবার দলীয় এমপি জেরিমি করভিন, রুশনারা আলী, কনজারভেটিভ দলীয় এমইপি চার্লস টেনক এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক আব্বাস ফয়েজ প্রমুখ।
বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বকারী গ্রুপ সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, একেএম মশিউর রহমান, দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরী, দীপঙ্কর তালুকদার এমপি ও তারানা হালিম এমপি। বিএনপির পক্ষে দলের মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শমসের মুবিন চৌধুরী, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, দলীয় নেতা এম এ মান্নান, মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম, দলীয় নেতা মনিষ দেওয়ান ও অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী প্রমুখ সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।
ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মিজারুল কায়েস, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফ, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুক, সহ-সভাপতি জালাল উদ্দিন এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি সাইস্তা চৌধুরী কুদ্দুস, সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এ সালামও সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিটিশ রাজনীতিকরা বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিবাদের নামে সাম্প্রতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, যেকোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করা সবার গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও এধরনের সহিংসতা কোনোভাবেই প্রতিবাদের অংশ হতে পারে না।

অ্যান্টি-টেরোরিজম বিষয়ক টাস্কফোর্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত লর্ড কারলাইল কিউসি সম্প্রতি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় প্রকাশের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেন তার বক্তৃতায়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর এই ন্যাক্কারজনক নির্যাতনের দায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে।
তিনি বাংলাদেশে নতুন করে মৌলবাদী শক্তির উত্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবেই দেখার স্বপ্ন দেখি আমরা। কিন্তু মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক উত্থান, প্রতিবাদের নামে সারা দেশে সহিংসতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন এবং এই নির্যাতন রুখতে রাজনৈতিক দলগুলোর অসফলতা কারণে এই স্বপ্ন কতটুকু বাস্তব হবে, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই সন্দেহ তৈরি হতে শুরু করেছে।’
তিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি আবারও ব্রিটেনের সমর্থনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান আমরা বারবার স্মরণ করিয়ে দিলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইনের প্রতিও আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। বিচার যাতে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয় সেদিকে বাংলাদেশ সরকার অবশ্যই দৃষ্টি রাখছে বলে নিশ্চয়ই আমরা আশা করতে পারি।’
জেরিমি করভিন এমপি, বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের সাম্প্রতিক ডিজ্যাস্টারের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘অর্থনীতিতে বাংলাদেশের যে অপার সম্ভাবনা গার্মেন্টস সেক্টরের উন্নয়ন ছাড়া তা সম্ভাবনাই থেকে যাবে, বাস্তবতার মুখ দেখবে না। তিনি আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী গার্মেন্টস সেক্টরের উন্নয়নে সরকারকে যত দ্রত সম্ভব মনোযোগী হওয়ার ওপর তাগিদ দেন। এক্ষেত্রে বিরোধী দলকেও দায়িত্বশীলতার ভূমিকা দেখানোর আহবান জানান জেরিমি করভিন।
আগামি পার্লামেন্ট নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধীদলীয় দাবি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ব্যারোনেস পলা উদ্দিন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘নীতিগতভাবে আমার অবস্থান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিপরীতে। কারণ রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাজনীতিকদের জন্যে সুনাম নয়। একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন উপহার দিতে পারে এটি আমরা বিশ্বাস করি।’
তিনি গার্মেন্টস সেক্টরের উন্নয়ন আদায়ে বিদেশি জিএসপি বাতিল কোনো সমাধান নয় উল্লেখ করে বলেন, ‘এই সেক্টরের উন্নয়নে সরকারকে তাগিদ দেয়ার পাশাপাশি সহযোগিতাও করতে হবে।’
রাজনীতিতে সহিংসতার তীব্র বিরোধিতা করে রুশনারা আলী এমপি বলেন, ‘আমার মাতৃভূমিতে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবর আমাকে পীড়া দেয়। প্রতিবাদের নামে রাজনৈতিক সহিংসতা বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রাকে যে ব্যাহত করে এটি বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদেরই বুঝতে হবে, বিদেশিদের বুঝলে হবে না।’
চার্লস টেনক এমইপি বাংলাদেশের আগামি নির্বাচন প্রক্রিয়া বিষয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ‘সরকার অনুমতি দিলে ইউরোপীয় একটি পার্লামেন্টারি গ্রুপ বাংলাদেশের আগামি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে যেতে পারে।’
লর্ড এভিবারি তার বক্তৃতায় বাংলাদেশে সাম্প্র্রতিক সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘জনগণের বাক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও এই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বাংলাদেশের সেক্যুলার ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্রীয় চেতনাকেই যে আঘাত করে এটি রাজনীতিকরা না বুঝলে বাংলাদেশের সামনে কঠিন ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে।’
তিনি সদ্য সমাপ্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার প্রশংসা করে বলেন, ‘এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে আগামি সাধারণ নির্বাচনও অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কছে গ্রহণযোগ্য করে করা সম্ভব।’
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ঈমাম বাংলাদেশের আগামি নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার রুখতে সরকার সম্ভব সব কিছু করবে মন্তব্য করে এ বিষয়ে ব্রিটেনসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতিসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতেই রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।’
সম্প্রতি প্রকাশিত হেফাজত নেতা আল্লামা শফীর রেকর্ডকৃত ওয়াজের কথা উল্লেখ করে তারানা হালিম এমপি বলেন, ‘নারীদের ক্ষমতায়নে বর্তমান সরকারের সামগ্রিক সফলতা আজ হুমকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশকে পেছন দিকে ফিরিয়ে নিতে হেফাজত-জামায়াতের ভয়ঙ্কর তৎপরতারই প্রমাণ আহমেদ শফীর নারীবিদ্বেষী কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য।’
বাংলাদেশ সময়: ১০০১ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৩
Link to Article
0 comments:
Post a Comment